ড. বিশ্বজিৎ মণ্ডলের নিয়োগ নিয়ে আইডিআরএ’র ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

যমুনা লাইফে নতুন মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের নির্দেশনা, বিরত থাকতে আইনজীবীর চিঠি

নিজস্ব প্রতিবেদক: হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদ থেকে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে অপসারণ করে আইডিআরএ। এই মামলাটির শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। ফলে মামলাটি চলমান এবং বিচারাধীন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে যমুনা লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের নিয়োগ না-মঞ্জুর করে আইডিআরএ।

অথচ যমুনা লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগের প্রস্তাব না-মঞ্জুরের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের দায়ের করা রিট মামলা উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশকে স্থগিত ও ৮ সপ্তাহের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করার চেম্বার জজ আদালতের নির্দেশনাকে বিচারাধীন হিসেবে মনে করেনি আইডিআরএ। ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের পরিবর্তে যমুনা লাইফে নতুন মুখ্য নির্বাহী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে সংস্থাটি।

ফলে আইডিআরএ’র এই পদক্ষেপ বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের ন্যায় বিচার পাওয়া বাধাগ্রস্ত করবে কিনা এবং আদালতের আদেশকে অবজ্ঞা করা হবে কিনা তা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বজিৎ মণ্ডলের নিয়োগকে কেন্দ্র করে আইডিআরএ’র ভূমিকা কতটা নিরপেক্ষ তা নিয়েও।

ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের আইনজীবী আইডিআরএ’কে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের পরিবর্তে নতুন কোন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলে তা হবে ন্যায়বিচারের প্রতি বাধা এবং বিচারাধীন মামলার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন।

বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের পরিবর্তে নতুন কাউকে নিয়োগ দিতে গত ৩ জুলাই ২০২৫ যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

চিঠিতে বলা হয়, গত ৬ এপ্রিল কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের নিয়োগ প্রস্তাব না-মঞ্জুর করায় তিনি হাইকোর্ট বিভাগে ৬৬৫৭/২০২৫ নম্বর রিট মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ আপিল বিভাগে উক্ত রিট মামলার বিরুদ্ধে ১৯৭১/ ২০২৫ নম্বর আপিল দায়ের করলে আপিল বিভাগ কর্তৃক ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের রিট মামলাটি ভ্যাকেট করা হয়। আপিল বিভাগ ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের রিট মামলাটি ৮ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন, পাশাপাশি একটি রুল জারি করেন।

চিঠিতে আরো বলা হয়, বীমা আইন ২০১০ এর ৮০(৪) ধারা এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা- ২০১২ অনুসারে কোন কোম্পানিতে একাধারে ৩ মাসের অধিক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ শূন্য রাখা যাবে না। ফলে ৩ মাস পূর্ণ হওয়ার ১৫ দিন আগেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগের প্রস্তাব কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রেরণের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

আইডিআরএ’র ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, মহামান্য আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ অনুযায়ী যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে একজন যোগ্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

তবে চিঠিতে আইনের ৮০(৪) ধারায় যে আরো বলা হয়েছে, “...তবে শর্ত থাকে যে, কর্তৃপক্ষ অপরিহার্য পরিস্থিতি বিবেচনায় উক্ত সময় সীমা আরো ৩ (তিন) মাস বর্ধিত করিতে পারিবে৷” তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

আইডিআরএ’র চিঠিতে, “মহামান্য আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে” মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হলেও আইনজীবী শাহ মোহাম্মদ এজাজ রহমানের মতে, সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটি একটি ‘অন্তর্বর্তী আদেশ’, কোন রায় নয়। ফলে অন্তর্বর্তী আদেশকে রায় বলে ভুল ব্যাখ্যা করেছে আইডিআরএ।

শাহ মোহাম্মদ এজাজ রহমান ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের আইনজীবী। অন্তর্বর্তী আদেশকে রায় বলে ভুল ব্যাখ্যা করার এই মতামত তিনি তুলে ধরেছেন আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে লেখা এক চিঠিতে। এই চিঠিতে তিনি আইডিআরএ চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছেন, যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে নতুন কোন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে।

শাহ মোহাম্মদ এজাজ রহমান চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের আদেশের ওপর ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ এবং কোর্ট খোলার পর রিট নিষ্পত্তির ক্ষমতাপ্রাপ্ত যেকোন হাইকোর্ট বেঞ্চে ৮ সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যা এখনো বিচারাধীন।

যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের পরিবর্তে নতুন কোন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলে তা হবে ন্যায়বিচারের প্রতি বাধা এবং বিচারাধীন রিট পিটিশন (নং-৬৬৫৭/২০২৫) এবং সিভিল পিটিশন ফর লীভ টু আপিল (নং- ১৯৭১/২০২৫) বিচারাধীন ২টি মামলার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন আইনজীবী শাহ মোহাম্মদ এজাজ রহমান।

চলতি বছরের ৬ এপ্রিল ২০২৫ যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের নিয়োগ প্রস্তাব না-মঞ্জুর করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এই নিয়োগ প্রস্তাব না-মঞ্জুরের ক্ষেত্রে দু’দফা চিঠি ইস্যু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

৬ এপ্রিল ২০২৫ এর প্রথম দফার চিঠিতে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের অপসারণ সংক্রান্ত মামলাকে বিচারাধীন উল্লেখ করে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানামালা-২০১২ এর ৭(৬) অনুযায়ী না-মঞ্জুর করা হয়।

প্রবিধানমালার ৭(৬)-এ বলা হয়েছে, “এই ধারার অধীন অপসারিত কোন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বীমা কোম্পানির অন্য কোন পদে নিয়োজিত বা পুনঃনিয়োজিত হইতে পারিবেন না।”

পরবর্তীতে নিয়োগ না-মঞ্জুরের এই চিঠি সংশোধন করে আইডিআরএ। এই চিঠিটি সংশোধনী না বলে ‘একই স্মারকে প্রতিস্থাপিত’ উল্লেখ করে দ্বিতীয় দফায় চিঠিটি দেয়া হয় ২৪ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে। প্রথম চিঠি ইস্যু করার ১৭ দিন পর এই প্রথম চিঠির ভুল সংশোধন করা হয়।

দ্বিতীয় দফায় দেয়া এই চিঠিতে না-মঞ্জুরের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, মামলাটি বর্তমানে চলমান এবং শুনানির জন্য অপেক্ষমান বিধায় বিষয়টি বিচারাধীন আছে। সেহেতু ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে বা অন্য কোন বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা সমীচীন নয় মর্মে প্রস্তাবটি না-মঞ্জুর করা হলো।

আইডিআরএ’র এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল রিট মামলা (নং-৬৬৫৭/২০২৫) দায়ের করেন। এই রিট মামলার প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশকে স্থগিত করার পাশাপাশি শুনানি করে মামলাটি ৮ সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য চেম্বার জজ আদালতের নির্দেশনাকে চলমান ও বিচারাধীন বলে মনে করেনি আইডিআরএ।

এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ পাওয়া নিয়ে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল ন্যায় বিচার পাবেন কিনা ? এর কারণ, শুনানি শেষে মামলার রায় বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলের পক্ষে থাকলে অপরদিকে তার আগেই যমুনা লাইফে নতুন কোন মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়া হলে মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুন্ন হবে কিনা- এটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল হোমল্যান্ড লাইফে নিয়োগ পান ২৪ মে ২০২২ তারিখে। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালের বিশেষ নিরীক্ষককে তথ্য না দেয়ার অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদ থেকে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলকে অপসারণ করে আইডিআরএ। অথচ ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল এই ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে এই কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন না।

শুধু বিশেষ নিরীক্ষককে তথ্য না দেয়ার অভিযোগে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী পদ থেকে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে অপসারণ করা হয়। যদিও তথ্য না দেয়ার অপরাধে কোন মুখ্য নির্বাহীকে অপসারণের কোন বিধান রাখা হয়নি বীমা আইনে।

অভিযোগ উঠেছিল, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তৎকালীন চেয়ারম্যানের সাথে হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালকদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। কোম্পানিটির পরিচালকরা নিজেদের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ঢাকতেই ড. বিশ্বজিৎ মণ্ডলকে অপসারণ করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবিত করতে এই ঘনিষ্ট সম্পর্ক কাজে লাগায়।

এছাড়াও পরিচালকদের মধ্যকার এই গ্রুপিং, মামলা ও বিবাদের কারণে হোমল্যান্ড লাইফের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান পর্যটন করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হান্নান মিয়া, যিনি ছিলেন তৎকালীণ আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বন্ধু (ব্যাচমেট) ।

হান্নান মিয়া কোম্পানির কাছে নানা ধরণের আর্থিক সুবিধা দাবি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নিয়ম বহির্ভুতভাবে কোম্পানির টাকায় এবং কোম্পানির অফিস ব্যবহার করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসন্ত উৎসব পালন, ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভারকে অফিসে নিয়োগ দিয়ে তার বেতন উত্তোলন, তেল-গ্যাস এবং ওভারটাইম সুবিধা প্রদানের অভিযোগ রয়েছে হান্নান মিয়ার বিরুদ্ধে।

আর এসব বিষয়ে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল আপত্তি জানালে হান্নান মিয়া তৎকালীন আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ জানান।

হান্নান মিয়া নিজেই চেয়ারম্যান হিসেবে মাসিক ৮০ হাজার টাকা ভাতার প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পর্ষদে উত্থাপন করেন, কিন্তু প্রস্তাবটি পর্ষদ নাকোচ করে।যার দায়ভারও তিনি ড. বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডলের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেন এবং বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ’র তৎকালীণ চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ জানান।

ফলে আইডিআরএ’র তৎকালীন কর্তৃপক্ষের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায় এবং ব্যক্তিগত রোষানলের শিকার হন ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল।

অপরদিকে বীমা আইনের ২৯ ধারা অনুসারে নিয়োগকৃত বিশেষ নিরীক্ষককে তথ্য না দেয়ার অভিযোগে বীমা আইনের ১৩৪ ধারায় ব্যক্তিগত জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে এই আইনের তোয়াক্কা না করে কর্তৃপক্ষের একক সিদ্ধান্তে ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডলকে অপসারণকে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দেখেন বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা।

ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল দাবি করেন, ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বার্থে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।

এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চেষ্টা করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। তবে সংস্থাটির পক্ষ থেকে কেউ কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।