অনিয়ম-দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের নিয়ে হোমল্যান্ড লাইফ পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক: অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ মামলার আসামি এখনো বহাল রয়েছে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদে। এসব ব্যক্তিকে নিয়মবহির্ভুতভাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। আবার তাদেরকেই কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রেখে কোম্পানি পরিচালনা করছে উচ্চ আদালতের গঠন করে দেয়া কোম্পানিটির অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড।

ফলে অন্তর্বর্তীকালীন এই বোর্ড নিয়মিত পরিচালনা পর্ষদ গঠনসহ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে কোম্পানিটির আর্থিক ভীত শক্তিশালী করার জন্য কতটা কাজ করতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

উল্লেখ্য, গত কয়েক বছর ধরেই গ্রাহকের ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, ভুঁয়া শেয়ার সার্টিফিকেটে পরিচালক হয়ে কোম্পানি থেকে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, ঢাকা ও লন্ডন প্রবাসী পরিচালকদের দ্বন্দ্ব,  গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধ করতে না পারার কারণে সংকট তৈরি হয়েছে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমেটেডে।

এই পরিস্থিতি চলমান থাকা অবস্থাতেই কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে অব্যাহতি ও নিয়োগ প্রদান এবং প্রকৃত উদ্যোক্তাদের নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের একাধিক মামলার প্রেক্ষিতে গত ৩ সেপ্টেম্বর বীমা কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট এই অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন করে দেয় উচ্চ আদালত।

বীমা কোম্পানিটির ম্যানেজমেন্টকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আইন মেনে যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি একটি নিয়মিত বোর্ড গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় অন্তর্বর্তীকালীন এই বোর্ডকে।

একইসাথে কোম্পানির আর্থিক ভীত শক্তিশালী করতে সকল বিধিবদ্ধ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করাসহ শেয়ারহোল্ডারস, পলিসিহোল্ডারস এবং পাওনাদারদের স্বার্থ রক্ষায় নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয় আদালতের এ সংক্রান্ত আদেশে।

অন্তর্বর্তীকালীন এই বোর্ডের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মজিদ। বোর্ড সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী আহসান, অতিরিক্ত সচিব (অবসরপ্রাপ্ত) মো. জাকির হোসেন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ফার্ম আহমেদ হক সিদ্দিকী অ্যান্ড কোং এর পার্টনার মোহাম্মদ শাকিল চৌধুরী (এফসিএ) এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) ও মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান উজমা চৌধুরী।

কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা, যেভাবে:

হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন। একইসঙ্গে তিনি কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারও দায়িত্ব পালন করছেন। শাহাদাত হোসেনকে প্রথমে কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে। এর ৩ মাস পরেই (৭ অক্টোবর, ২০২৪) তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

চাকরির অব্যাহতি পত্রে উল্লেখ করা হয়, ১ কোটি ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ৯০১ টাকার বীমা প্রিমিয়াম বকেয়া রাখা, কোন উন্নয়ন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে না পারা, কোম্পানির বিভিন্ন তথ্য পাচার, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হল।

আবার চাকরি থেকে শাহাদাত হোসেনকে অব্যাহতি দেয়ার ৩ মাস পরেই ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে পদোন্নতি দিয়ে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়ে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারও দায়িত্ব দেন কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন একক সিদ্ধান্তে এ নিয়োগ দেন।

শাহাদাত হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর কোম্পানির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন নিয়ম বহির্ভুতভাবে ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা নেন কোম্পানি থেকে। এই টাকা তিনি নেন আইও শ্লিপ দিয়ে। এসব টাকা উত্তোলনের নোটশিটে স্বাক্ষর করে শাহাদাত হোসেন। এর মধ্যে ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা তিনি নিজেই আইও শ্লিপে স্বাক্ষর দিয়ে গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অপরদিকে কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত জাকির হোসেন সরকার দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানিটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব মার্কেটিং পদে। জাকির হোসেন সরকার নিয়োগ পান ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে।

কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাকির হোসেন সরকার সারাদেশের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারদের কাছ থেকে প্রিমিয়ামের নামে প্রায় ৬০ লাখ টাকা নিয়েছেন এমন গুঞ্জন রয়েছে। তবে ব্যক্তিগত বিকাশ একাউন্ট ও নগদে টাকা নেয়ায় কোনো প্রমাণাদি দিতে পারছে না কেউ।

অপরদিকে জামাল উদ্দিনের ঘনিষ্ট ও কোম্পানিতে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণে জাকির হোসেন সরকারকে যারা টাকা দিয়েছেন তারা মৌখিকভাবে অভিযোগ করলেও চাকরি হারানোর ভয়ে লিখিত কোন অভিযোগ করছেন না।

হোমল্যান্ড লাইফের মামলা সংক্রান্ত নথিপত্রের তথ্য অনুসারে, মতিঝিল থানায় জাকির হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৮(১)১১নং মামলাটি উচ্চ আদালতে আদেশের অপেক্ষায় আছে। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে হোমল্যান্ড লাইফের ৮৫ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। আর কতোয়ালী থানার ০১(০১)১১নং মামলায় জাকির হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে কোম্পানির ৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।

শাহাদাত হোসেন ও জাকির হোসেন সরকারকে নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি কোম্পানির চেয়ারম্যান  জামাল উদ্দিন চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি হোমল্যান্ড লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল মতিনকে অব্যাহতি দেন। এর আগের দিন কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুৎফুন নাহার আলোকে অব্যাহতি দেন জামাল উদ্দিন। এই অব্যাহতি দেয়া হয় নিয়মবহির্ভুতভাবে।

আব্দুল মতিন ও  লুৎফুন নাহার আলোর অব্যাহতির বিষয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেন, নির্দেশনা না মানায় ওই দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে আব্দুল মতিনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় আব্দুল মতিনের অব্যাহতি পত্রে। অপরদিকে লুৎফুন নাহার আলোর অব্যাহতি পত্রে উল্লেখ করা হয় নিয়োগ পত্রের ৫নং শর্ত অনুসারে তাকে অব্যাহতি দেয়া হলো। আবার একইসাথে অভিযোগ আনা হয় ব্যবসার পারফরমেন্স সন্তোষজনক না হওয়া ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টির।

উল্লেখ্য, আব্দুল মতিনকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর কোম্পানির ১৪৯তম সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে।

চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের দেয়া এই অব্যাহতিকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করেন আব্দুল মতিন ও লুৎফুন নাহার আলো।

পরবর্তীতে আব্দুল মতিন ও লুৎফুন্নাহার আলোকে অব্যাহতি দিয়ে শাহাদাত হোসেন ও জাকির হোসেন সরকারের নিয়োগের বিষয়সহ কোম্পানির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের একক সিদ্ধান্তে কোম্পানি পরিচালনার বিরুদ্ধে রিট মামলা দায়ের করেন কোম্পানির পরিচালক এরশাদ করিম। ২০২৫ সালের ১ জুন কোম্পানি আইনের ২৩৩ ধারায় দায়েরকৃত রিট মামলা নং ৯৪১/২০২৫।

এই রিটের শুনানি শেষে আদালত শাহাদত হোসেন ও জাকির হোসেন সরকারের নিয়োগপত্র এবং আব্দুল মতিন ও লুৎফুন্নাহার আলোর অব্যাহতিপত্র ৩ মাসের জন্য স্থগিত করেন। পরবর্তীতে ২৭ আগস্ট আদালত রিট মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ বর্ধিত করেন।

অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশের ২৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, আব্দুল মতিন ও লুৎফুন নাহার আলো চাকরি থেকে অব্যাহতি ও শাহাদাত হোসেন এবং জাকির হোসেন সরকারের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড কোম্পানির বর্তমান পরিস্থিতি এবং কোম্পানি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা, কোম্পানির কল্যাণ ও সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

তবে এই ৪ কর্মকর্তার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন প্রকার সিদ্ধান্ত নেয়নি হাইকোর্টের গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড।

অথচ শাহাদাত হোসেন কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ এবং জাকির হোসেন সরকার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (মার্কেটিং) পদে বহাল তবিয়তে আছেন এবং কোম্পানির নথিপত্রে স্বাক্ষর করছেন।

অপরদিকে শাহাদত হোসেনের দায়ের করা একটি মামলার কারণে আব্দুল মতিন ও লুৎফুন নাহার আলো কোম্পানিতে ঢুকে কোনো কর্মকান্ড করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থা (মামলা নং-১২২০৪/২৩) থাকার পরও হোমল্যান্ড লাইফে নতুন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড। এর লক্ষ্যে গত ৩০ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে এবং আবেদনের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী পদে অজিত চন্দ্র আইচকে নির্বাচন করা হয়েছে বলে কোম্পানির একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

অভিযোগের বিষয়ে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা:

শাহাদত হোসেনের চাকরির অব্যাহতি পত্রে উল্লেখ করা ১ কোটি ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ৯০১ টাকার বীমা প্রিমিয়াম বকেয়া রাখার বিষয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে তিনি বলেন, এগুলো মূলত ডিসিএস (ডেইলি কালকশন স্টেটমেন্ট)’র বকেয়া। এসব টাকার সাথে আমি সম্পৃক্ত নই।

আইও শ্লিপ দিয়ে ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা নেয়ার বিষয়ে শাহাদত হোসেন বলেন, কর্মীদের পাওনা কমিশন ও কোম্পানির সম্পদ সংরক্ষণের মামলা সংক্রান্ত খরচ প্রদানের নথিতে স্বাক্ষর করেছি। আমি কোন টাকা গ্রহণ করিনি। এ ধরণের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এর কোন প্রমাণ নেই।

অর্থ আত্মসাৎ মামলার বিষয়ে জাকির হোসেন সরকার বলেন, ২০১০ সালে নতুন ম্যানেজমেন্ট কিছু অনৈতিক প্রস্তাব দিলে সেগুলো আমি প্রত্যাখ্যান করি এবং চাকরি থেকে ইস্তফা দেই। ফলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে হয়রানি করার জন্য এসব মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে প্রাক্তন চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন কোম্পানির স্বার্থে আমাকে নিয়োগ প্রদান করে।

আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ৪ কর্মকর্তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে শাহাদত হোসেনের স্বাক্ষর করা এবং আদালতের স্থিতাবস্থা থাকার পরও নতুন মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার বিষয়ে জানতে চাইলে হোমল্যান্ড লাইফের অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. আব্দুল মজিদ বলেন, আমরা আদালতের নির্দেশনা অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করছি। তবে এখনো আমরা পুরোপুরি স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে পারিনি। আমরা আইন-কানুনগুলো ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করছি। এরপর সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।