বীমা আইন-২০১০ সংশোধনী: যা বলছে গণমাধ্যমগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের বীমা খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা, আইন বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কার্যকারিতা নিয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি আয়োজিত মতবিনিময় সভা দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় পরিণত হয়েছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সভায় বীমা আইন-২০১০ এর সংশোধনী এবং সামগ্রিক খাত সংস্কার নিয়ে বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা মতামত তুলে ধরেন। আয়োজনের পর দেশের প্রধান দৈনিক ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে, যা বীমা খাত সংস্কার নিয়ে জাতীয় আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বীমা খাতের সংকট সমাধানে মূল আলোচ্য হিসেবে আইডিআরএ সংস্কার
সভায় আলোচকরা অভিন্নভাবে বলেন, বীমা আইন-২০১০- এ আগে থেকেই নিরীক্ষা, তদন্ত, প্রশাসক নিয়োগ, জবাবদিহিহীনতা রোধ, আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধারসহ কঠোর অনেক বিধান বিদ্যমান। এই আইন প্রণীত হওয়ার পরও বীমা খাত প্রত্যাশা অনুযায়ী অগ্রসর হয়নি, কারণ আইন প্রয়োগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা, দক্ষতার ঘাটতি এবং কাঠামোগত অসংগতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এ মত দেন যে, আইডিআরএ তার নীতিনির্ধারণ, তদারকি, আইন প্রয়োগ এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা দেখাতে না পারলে নতুন বিধান যোগ করলেও পরিস্থিতি আমূল বদলাবে না।
বীমা খাত এখনও জনআস্থার সংকটে ভুগছে, দাবি নিষ্পত্তিতে ভোগান্তি রয়েছে, অনেক কোম্পানিতে করপোরেট গভর্ন্যান্স কমজোরি। তাই আইডিআরএকে শক্তিশালী এবং জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলাই এখন খাতকে এগিয়ে নেয়ার প্রধান পূর্বশর্ত। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে এই বার্তাই সবচেয়ে শক্তভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
জাতীয় দৈনিকগুলোর খবরের মূল সুর
দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে, বীমা খাত অনুন্নত ও অবহেলিত হওয়ায় আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেটির সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। তারা উল্লেখ করে যে, আইনটির উন্নয়নমুখী অংশগুলোর প্রতি সংশোধনী প্রস্তাবে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়ায় খাতের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
মানবজমিন, কালবেলা এবং সময়ের আলো একসঙ্গে জানায়, সংশোধনী প্রস্তাবে যেসব নতুন ধারা যোগ করার কথা রয়েছে, সেগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য উচ্চমানের দক্ষতা ও তদারকি সক্ষমতা প্রয়োজন। তাদের প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের মতামত উদ্ধৃত করে বলা হয়, বর্তমান আইডিআরএ কাঠামো দিয়ে এসব বিধান কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, স্বচ্ছ ও পেশাদার মডেলে পুনর্গঠন করাকে অপরিহার্য হিসেবে দেখানো হয়েছে।
যুগান্তর জানায়, বীমা খাতের স্বচ্ছতা, আর্থিক শৃঙ্খলা এবং দাবি নিষ্পত্তির মানোন্নয়নে আইডিআরএকে আরও শক্তিশালী ভূমিকায় যেতে হবে। তাদের প্রতিবেদনের বক্তব্যে স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়- আইডিআরএ সংস্কারের মাধ্যমে খাতে আস্থা ফেরাতে হবে, যা নতুন আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের পত্রিকা প্রকাশ করে যে, আইডিআরএর সক্ষমতার ঘাটতি দূর না করলে বীমা আইন- ২০১০- এর যেকোনো সংশোধনী কার্যকর হবে না। তারা নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে নির্দেশ করে যে, আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা অদূর ভবিষ্যতে বড় সংকট তৈরি করতে পারে।
দেশ রূপান্তর তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরে যে, বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগই যথেষ্ট। তারা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে জানায়, নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে অতিরিক্ত নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ বা কোম্পানি পরিচালনায় সরাসরি হস্তক্ষেপমূলক ক্ষমতা দিলে তা উল্টো বীমা খাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। তাই তারা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিই বীমা খাতের জন্য সবচেয়ে উপকারী বলে মন্তব্য করেছে।
ইংরেজি সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপন
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে জানায়, বীমা খাতের সুসংগতি, আধুনিকায়ন ও স্বচ্ছতা নির্ভর করে বিদ্যমান বীমা আইন- ২০১০- এর যথাযথ, কঠোর ও পক্ষপাতহীন প্রয়োগের ওপর। তারা জোর দিয়ে উল্লেখ করে যে, আইন পরিবর্তনের আগে বর্তমান কাঠামোর কার্যকারিতা পরীক্ষাই সবচেয়ে জরুরি। প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা দুর্বল থাকলে নতুন আইন বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে যাবে।
দেশের অনলাইন গণমাধ্যমেও একই সুর
ঢাকা পোস্ট, বাংলা ট্রিবিউন, সারাবাংলা, জাগো নিউজ, বাংলা নিউজ২৪ এবং রাইজিং বিডি সকলেই তাদের প্রতিবেদনে এক কণ্ঠে জানিয়েছেন- বিদ্যমান আইনের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বীমা খাতকে ঘুরে দাঁড় করানো সম্ভব। তাদের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উঠে আসে যে, আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা, কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষমতা আগে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
ঢাকা পোস্ট জানায়, বর্তমান সংকট মোকাবিলায় সংশোধনী আনার চেয়ে আইডিআরএকে কার্যকরভাবে আইন প্রয়োগে আগ্রহী ও সক্ষম করে তোলাই জরুরি।
বাংলা ট্রিবিউন উল্লেখ করে, আইডিআরএ আন্তরিকতা ও কার্যকারিতায় ঘাটতি থাকায় আইনের অনেক ধারা বাস্তবে প্রয়োগ হয় না, ফলে নতুন সংশোধনী খাতের সমস্যার মূলে পৌঁছাতে পারবে না।
জাগো নিউজ জানায়, নতুন ধারা বাস্তবায়নে আইডিআরএ’র চৌকস, দক্ষ ও নিরপেক্ষ অবস্থান জরুরি।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি প্রতিবেদনে তুলে ধরে, বীমা আইন-২০১০- এ আগেই রয়েছে নিরীক্ষা, তদন্ত, প্রশাসক নিয়োগ, আইন লঙ্ঘনকারীদের অপসারণ, আত্মসাতের অর্থ উদ্ধারের বিধান। ফলে বীমা খাতের উন্নয়ন ও সংস্কার বিদ্যমান আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়েই সম্ভব। তারা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন- বীমা আইনের সংশোধনের চেয়ে বেশি দরকার আইন প্রয়োগের প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদিচ্ছা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একাধিক সংবাদমাধ্যমই স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে- আইডিআরএ সংস্কারের কাঠামোগত প্রক্রিয়া শুরু না হলে বীমা খাতের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে।
গণমাধ্যমের অভিন্ন বার্তা: সংস্কারের শুরু হোক নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দিয়ে
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি আয়োজিত মতবিনিময় সভার আলোচনাকে দেশে কার্যত একটি ঐক্যমত্য গড়ে তুলেছে। সেই ঐক্যমত্য হলো, বীমা খাতের প্রধান সংকট আইনগত নয়, বরং আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা। আইন- ২০১০- এ থাকা শক্তিশালী বিধানগুলো বাস্তবে প্রয়োগ না হওয়াই বীমা খাত পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই আইন বদলানোর আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএকে দক্ষ, আধুনিক, স্বচ্ছ এবং গ্রাহকবান্ধব মডেলে রূপান্তর করা অপরিহার্য।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র এই মতবিনিময় সভা বীমা খাতের সংস্কার প্রসঙ্গকে জাতীয় গণমাধ্যমে নতুনভাবে আলোচনায় এনেছে। প্রায় সব শীর্ষ গণমাধ্যমেই যে বার্তা সবচেয়ে জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তা হলো- বীমা খাত উন্নয়নের জন্য বিদ্যমান আইন-২০১০ সংশোধনের আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠন করতে হবে।




