সংস্কারের তোড়জোড় আর অমীমাংসিত সংকটে কাটল ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা চড়াই-উতরাই, নীতি নির্ধারণী বিতর্ক এবং আইনি সংস্কারের ডামাডোলে শেষ হলো ২০২৫ সাল। বিদায়ী এই বছরে বাংলাদেশের বীমা খাত একদিকে যেমন আধুনিকায়নের পথে হেঁটেছে, অন্যদিকে পুরনো সংকট ও নতুন কিছু সিদ্ধান্তে অস্থিরতাও বিরাজ করেছে। বিশেষ করে মোটর বীমার নতুন নীতিমালা, ১৭ কোম্পানিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা এবং এজেন্ট কমিশন বাতিলের মতো ইস্যুগুলো ছিল বছরজুড়ে টক অব দ্য টাউন।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য বিদায়ী বছরের আলোচিত ১০টি প্রধান ঘটনা বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ড ও বড় অংকের বীমা দাবি:
বছরের শেষ প্রান্তিকে (১৮ অক্টোবর) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিগুলোকে বড় অংকের বীমা দাবি পরিশোধের মুখে পড়তে হয়েছে। এটি গত কয়েক বছরের মধ্যে শিল্পখাতে হওয়া অন্যতম বৃহৎ দাবি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
১৫ লাইফ ও ১৭ নন-লাইফ কোম্পানিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তকমা:
কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন বা স্বচ্ছতা ছাড়াই দেশের ১৫টি লাইফ বীমা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা উচ্চ ঝুঁকিতে এবং ১৭টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম। চলতি বছরের ২ জুলাই সংস্থাটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্য ও সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান। কোম্পানিগুলোর দাবি, মনগড়া তত্ত্বে দেয়া এই তকমা সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে।
এসবিসি’র পাওনা ও পুনর্বীমা চুক্তিহীন ৩৬ কোম্পানি:
আইন অনুসারে বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনের সাথে পুনর্বীমা চুক্তি করতে হয়। প্রতি বছর এই চুক্তি নবায়ন করতে হয় ৩১ মার্চের মধ্যে। এই সময় আরো এক মাস বৃদ্ধি করে থাকে সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি) ।
তবে দেনা-পাওনা নিয়ে জটিলতার কারণে বেসরকারি খাতের ৩৬টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির পুনর্বীমা চুক্তি (Reinsurance Treaty) অনুমোদন বেশ কিছু দিন বন্ধ রেখেছিল এসবিসি। ফলে গ্রাহকদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রশ্নের মুখে পড়ে। এসবিসি’র দাবি, কোম্পানিগুলোর কাছে তাদের বকেয়া পাওনা ১০৮৪ কোটি ৬ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
নতুন আঙ্গিকে মোটর বীমা ও বাধ্যবাধকতা বিতর্ক:
মটর বীমা বা থার্ড পার্টি বীমা বাধ্যতামূলক করার আইনি বিধান তুলে দেয়ার পর নতুন আঙ্গিকে এই বীমা চালু করা হয়েছে। সার্কুলার নং- নন-লাইফ ১০৫-২০২৫ জারি করে গত ৭ আগস্ট “মটর লাইয়াবিলিটি ইন্সুরেন্স পলিসি” নামে এটি চালু করা হয়। তবে পলিসি গ্রহণে কঠোর বাধ্যবাধকতা না থাকায় সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে, যা নন-লাইফ খাতের প্রিমিয়াম আয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
ব্যক্তি এজেন্ট লাইসেন্স স্থগিত, উন্নয়ন কর্মীদের পে-স্কেলে বেতনের সিদ্ধান্ত:
২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নন-লাইফ বীমা খাতে ১৫ শতাংশ এজেন্ট কমিশন বাতিলসহ ব্যক্তি এজেন্ট লাইসেন্স স্থগিত ঘোষণা করে সার্কুলার জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। একইসঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ছাড়া অন্যান্য সব উন্নয়ন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত পে-স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা উল্লেখ করে নিয়োগপত্র প্রদান এবং সে অনুযায়ী নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে বলা হয়। তবে এই সিদ্ধান্তের ফলে কয়েক হাজার মাঠকর্মী বেকার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় নন-লাইফ বীমা খাতে।
৫০% পুনর্বীমার বাধ্যবাধকতা বাতিলের প্রস্তাব ও আন্দোলন:
বেসরকারি কোম্পানির জন্য সাধারণ বীমা করপোরেশনে ৫০% পুনর্বীমা করার আইন শিথিল করার প্রস্তাব দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে মাঠে নামেন এসবিসি’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের দাবি, এতে দেশীয় সম্পদ বিদেশে চলে যাবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হয়ে পড়বে।
বীমা আইন সংশোধন ও সঠিক প্রয়োগের দাবি:
বীমা আইন ২০১০ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে বছরজুড়ে একাধিক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইডিআরএ-বিআইএ ছাড়াও ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংস্কারের জন্য শুধু আইন সংশোধন করলেই হবে না; বরং প্রয়োজন বিদ্যমান আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ।
২০১০ সালে প্রণীত বীমা আইন ২০১০ এর মূল ১৬০টি ধারার মধ্যে ৯৯টি মূল ধারা অপরিবর্তিত রেখেছে। কিন্তু সেগুলোর উপধারাগুলো পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধনীতে। বাকী ৬১টি ধারার উপধারাসহ তাদের পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজনের সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। মূল ১৬০টি ধারার মধ্যে- কয়েকটি বিলুপ্ত বা বাতিলের প্রস্তাব করেছে। অধিকন্তু ৬৪ নতুন ধারা, উপ-ধারাসহ সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে।
মুখ্য নির্বাহী পদে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিয়োগের উদ্যোগে বিতর্ক:
যোগ্য ও দক্ষ লোকের অভাব দূর করতে এবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদের অভিজ্ঞতায় আরো ছাড় দেয়া হচ্ছে। সরকারের এই উদ্যোগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতে।
পেশাদার বীমা কর্মকর্তাদের দাবি, বীমা একটি বিশেষায়িত টেকনিক্যাল খাত, যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলে খাতের অভ্যন্তরীণ সংকট আরও বাড়তে পারে।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে লক্ষ্যে বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২ এর প্রস্তাবিত খসড়া প্রজ্ঞাপনের ওপর মতামত চেয়ে গত ২৬ জুন এটি আইডিআরএ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। একইসঙ্গে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজন, বিশেষজ্ঞ, জনসাধারণের মতামত আহবান করা হয়।
সিইও ও একচুয়ারি পুল গঠন:
যোগ্য নেতৃত্বের সংকট কাটাতে এবং দক্ষ জনবল তৈরিতে আইডিআরএ প্রথমবারের মতো ‘সিইও পুল’ এবং ‘একচুয়ারি পুল’ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যোগ্য বীমাবিদদের এই পুলে যোগ দিতে আবেদন আহবান করে গত ১৬ মে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আইডিআরএ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই উদ্যোগ দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বীমাকারী রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-গবেষণা গাইডলাইনসহ একগুচ্ছ নতুন নির্দেশনা:
দেশের লাইফ ও নন-লাইফ বীমা খাতের সক্ষমতা বাড়াতে বিদায়ী বছরে ১১টি নতুন সার্কুলার ও নির্দেশনা জারি করেছে আইডিআরএ। এ ছাড়াও ‘বীমাকারী রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ এবং ‘গবেষণা গাইডলাইন’ জারি করা হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বীমা খাতের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
২০২৫ সালের এই ঘটনাপ্রবাহ আগামী বছরে বাংলাদেশের বীমা খাতের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।




