বীমা দাবি পেতে ৪ বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে মিনিস্টার হাইটেক পার্কের বিভ্রান্তিকর অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা দাবির ক্ষয়ক্ষতি নিরুপনের জন্য আগুনে পুড়ে যাওয়া মালামালের স্টক রেজিস্টারসহ ৫ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র দাখিল না করে উল্টো জরিপকারী ও বীমা  কোম্পানির বিরুদ্ধে জরিপ প্রতিবেদন না দেয়ার অভিযোগ করেছে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লিমিটেড ও মাইওয়ান ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এমন বিভ্রান্তিকর অভিযোগ করা হয়েছে ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ এবং রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। গত ২৫ নভেম্বর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে বিভ্রান্তিকর এ অভিযোগ দাখিল করেছেন প্রতিষ্ঠান দু’টির চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান।

অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১১ ডিসেম্বর এ বিষয়ে বীমা কোম্পানিগুলোর বক্তব্য জানতে চিঠি পাঠিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । চিঠিতে বীমা কোম্পানিগুলোর নিয়োগকৃত জরিপকারীগণের তথ্যাদি উল্লেখপূর্বক প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ ৫ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য পাঠাতে বলা হয়। বীমা কোম্পানি ও জরিপকারীদের সাথে আলাপকালে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’কে জানিয়েছে ইতোমধ্যে তারা আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগের জবাব দাখিল করেছে।

সূত্র মতে, ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় গাজীপুরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান দু’টির কারখানা ভবনের ষষ্ঠ তলায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট ৯ ঘণ্টা চেষ্টার পর ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

জানা যায়, ৪টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিতে মোট ৭টি অগ্নি বীমা পলিসিতে ১৩৯ কোটি ৬১ লাখ ২৫ হাজার ৬৮১ টাকার বীমা করেছে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক লিমিটেড ও মাইওয়ান ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এরমধ্যে ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সে ৩টি পলিসিতে ৫১ কোটি টাকা, ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে ২৬ কোটি ৩৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭শ.৭১ টাকা, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সে ২৯ কোটি ২৩ লাখ ৪১ হাজার ৯শ’১০ টাকা রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সে ৩০ কোটি টাকার বীমা করে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক ও মাইওয়ান ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ।

আইডিআরএ’র কাছে দাখিল করা অভিযোগ ও বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে দাখিল করা কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বীমা গ্রাহক মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক ও মাইওয়ান ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করে ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর। এতে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের দু’দিন পর ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে দাবি উত্থাপন করা হয়। এরপর সকল বীমা কোম্পানি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণেয় করতে জরিপকারী নিয়োগ করে। সরকারি বিধি অনুসারে অগ্নিকাণ্ডের ৩০ দিনের মধ্যে জরিপ প্রতিবেদন দেয়ার কথা। কিন্তু এরইমধ্যে ৭৩ দিন অতিবাহিত হলেও জরিপ প্রতিবেদন দাখিল করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।

অথচ মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক ও মাইওয়ান ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ’র কর্মকর্তা মজিবুর রহমান গত ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে এক পত্রে ২১ ধরনের নথিপত্র দেয়ার বিষয়ে তথ্য প্রদান করেন। তবে এসব নথিপত্রের মধ্যে বীমা জরিপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৫ ধরনের তথ্য পরবর্তীতে জমা দেয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

কাগজপত্রগুলো হলো- ব্যাংকে দাখিলকৃত মূল্যসহ এলইডি টিভি’র গত ১ বছরের স্টক স্টেটমেন্ট, গত ১ বছরের এলইডি টিভি’র প্রডাকশন রেজিস্ট্রার, ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চালানসহ সকল আগমন ও বহির্গমনের গেট রেজিস্ট্রার, বৈদ্যতিক শর্ট সার্কিট প্রতিরোধে গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এবং ক্লেইম বিল এর বিস্তারিত তথ্য।

জরিপকারীদের জরিপকাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ না করেই গ্রাহকের এমন অভিযোগের বিষয়ে বীমাখাত সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, সাধারণত অন্যায়ভাবে বীমা দাবি নাকোচ করা হলে অথবা কোনো বীমা কোম্পানি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বীমা দাবি পরিশোধে গ্রাহককে হয়রানি করলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক বীমা দাবি আদায়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে অভিযোগ করে থাকে। তবে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক নিজেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করেনি, উল্টো বীমা কোম্পানি ও জরিপকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। যা অস্বাভাবিক।

ওই অভিযোগে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডে ৪২ কোটি টাকা ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে বীমা কোম্পানিগুলোর নিয়োগকৃত জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলো ৪২ কোটি টাকার পরিবর্তে ১৫ কোটি টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে বীমা কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, বীমা গ্রাহকের সাথে দাবি পরিশোধের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তারা আরো বলেন, বীমা জরিপ প্রতিবেদন পাওয়ার আগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বা বীমা দাবির পরিমোণ নির্ধারনের কোনো সুযোগ নেই।

ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা তালুকদার মো. জাকারিয়া হোসেন এ বিষয়ে বলেন, সাধারণত কোনো বীমা দাবি নাকোচ করা হলে অথবা কোনো কোম্পানি দাবি পরিশোধে সময়ক্ষেপণ করলে গ্রাহক অভিযোগ করে থাকে। কিন্তু আমারা মিনিস্টারের সার্ভে রিপোর্টই হাতে পাইনি। সার্ভে রিপোর্ট ছাড়া ক্লেইম দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর যেহেতু সার্ভে রিপোর্ট পাইনি তাই ১৫ কোটি টাকা দিব এ ধরণের কোনো আলোচনা আমাদের সাথে হয়নি। আসলে এ ধরনের আলোচনা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অভিযোগের বিষয়ে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবদুল খালেক মিয়া বলেন, তারা আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেছে। আইডিআরএ আমাদের কাছে চিঠি দিলে আমরা তা সার্ভেয়ারের কাছে পাঠিয়েছি। এখন সঠিকভাবে অভিযোগ না হলে তা দেখার দায়িত্ব আইডিআরএ’র । এক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকে বলার কিছু নেই।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে গাজীপুরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান দু’টির কারখানা ভবনের ষষ্ঠ তলায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট ৯ ঘণ্টা চেষ্টার পর ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এরইমধ্যে ভবনের ষষ্ঠ ও শীর্ষ তলায় প্রতিষ্ঠান দু’টির প্রস্তৃতকৃত সকল পণ্য সম্পূর্ণভাবে ভষ্মিভূত হয়ে যায়।

এ ছাড়াও ভবনের পঞ্চম তলা থেকে নীচ তলা পর্যন্ত রক্ষিত বিপুল পরিমাণ পণ্য ও কাঁচামাল এবং মেশিনারিজ আগুনের তাপে এবং অগ্নি নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের ব্যবহৃত পানিতে সম্পূর্ণ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিষ্ঠান দু’টির আনুমানিক হিসাবে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ব্যাংক থেকে নেয়া ৪০০ কোটি টাকা ঋণের মেয়াদ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক ও মাইওয়ান ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ। কিন্তু জরিপ প্রতিবেদন হাতে না পাওয়ায় ঋণ নবায়নের প্রস্তাব করতে পারছে না মিনিস্টার হাই-টেক পার্ক ও মাইওয়ান ইলেক্ট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ।

এ বিষয়ে মিনিস্টার হাইটেক পার্ক প্রধান কার্যালয়ের সিএফও সিরাজুল ইসলামের সাথে কথা বলা হলে তিনি পরে এ বিষয়ে মতামত জানাবেন বলে জানান। কিন্তু পরে কোনো মতামত দেননি। পরে মিনিস্টার হাইটেক পার্কের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। পরে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।