গ্রাহকের সব টাকা খেয়ে ফেলেছে আলফা ইসলামী লাইফ

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে দামি দামি ফার্নিচারের চোখ ধাঁধানো প্রধান কার্যালয়, মোটা বেতনের পদস্থ কর্মকর্তা, বিলাশবহুল গাড়ি ও অন্যান্য উপকরণ নিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিল আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ২০১৩ সালে ব্যবসার শুরুতেই এমন আয়োজনে আলফা ইসলামী লাইফ একটি ব্যবসা সফল বীমা কোম্পানি হবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল বীমাখাতের। কিন্তু বিগত ৬ বছরে ব্যবসা সফল তো হতেই পারেনি, উল্টো গ্রাহকের সব টাকা খেয়ে ফেলেছে। কোম্পানিটির তহবিলে গ্রাহকের দায় পরিশোধের আর কোনো টাকাই অবশিষ্ট নেই। উপরন্তু গেল বছরে মালিকদের জমা করা মূলধন থেকেও ২৬ লাখ টাকা খরচ করেছে কোম্পানিটি।

প্রিমিয়াম আয় ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, ব্যবস্থাপনা ব্যয় ৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা:

প্রিমিয়াম আয় যাই হোক না কেন খরচ কমেনি আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। সবশেষ হিসাব সমাপনী বছরের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে কোম্পানিটির প্রথম বর্ষ বা নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। আর ২০১৮ সালে যে ৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছিল তা থেকে নবায়ন এসেছে ৩০ লাখ টাকা। এই হিসেবে কোম্পানিটির মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

তবে তৃতীয় থেকে তদুর্ধ্ব বছরের কোন নবায়ন আসেনি। অথচ নবায়ন প্রিমিয়ামকে বলা হয় লাইফ বীমা কোম্পানির প্রাণ। তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে যে পরিমাণ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে তা থেকে কোন নবায়ন প্রিমিয়াম আসেনি ২০১৯ সালে। ফলে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে প্রিমিয়াম সংগ্রহে যে ব্যয় করেছে তার পুরোটাই লোকসান গুণতে হবে কোম্পানিটিকে। এছাড়াও রয়েছে গ্রাহকের জমানো প্রিমিয়ামের দায়।

অন্যদিকে ২০১৯ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে ৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় করেছে আলফা ইসলামী লাইফ। এর মধ্যে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহে ১ কোটি ৯ লাখ টাকা এবং নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহে ৪ লাখ টাকা কমিশন দিয়েছে। এ ছাড়াও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ ৫০ লাখ টাকা এবং অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। বাকী টাকা অফিস ভাড়াসহ ব্যবস্থাপনার অন্যান্য খাতে ব্যয় করেছে। অর্থাৎ প্রিমিয়াম আয়ের চেয়ে গেলো বছরে খরচ বেশি করেছে বীমা কোম্ম্পানিটি।

বিনিয়োগ  আয় ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, দাবি ও অন্যান্য খাতে ব্যয় ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা:

২০১৯ সালে আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স স্থায়ী আমানত (মূলধন), স্ট্যাটুটরি ডিপোজিট (বিজিটিবি), এমএসএনডি হিসাব এবং অন্যান্য খাত থেকে সর্বমোট আয় করেছে ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আর বিগত বছরগুলোতে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ডে জমা ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

অন্যদিকে ২০১৯ সালে কোম্পানিটি সারভাইভাল বেনিফিট, পলিসি সারেন্ডার ক্লেইম, মৃত্যুদাবি, গ্রুপ ও স্বাস্থ্য বীমা দাবি বাবদ পরিশোধ করেছে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আবার আর্থিক খরচ, স্থায়ী সম্পদের অবচয় খরচ এবং অবলোপন খরচ ইত্যাদি খাতে ব্যয় করেছে আরো ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বীমা দাবি পরিশোধ ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করেছে ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা।

আয়-ব্যয়ের ফলাফল- ২৬ লাখ টাকা ঘাটতি:

নতুন ও নবায়ন প্রিমিয়াম এবং লাইফ ফান্ডসহ সব ধরনের বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয় মিলিয়ে ২০১৯ সালে আলফা ইসলামী লাইফের নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও বীমা দাবিসহ অন্যান্য খাতে কোম্পানিটি আলোচ্য বছরে সর্বমোট খরচ করেছে ৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। হিসাব অনুসারে সর্বমোট আয় থেকে সর্বমোট ব্যয় বাদ দিলে ২০১৯ সালে কোম্পানিটির লাইফ ফান্ডে ঘাটতি দাঁড়ায় ২৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ বীমা গ্রাহকদের সব টাকা খরচের পর মালিকদের জমানো টাকা থেকেও ব্যয় করেছে আলফা ইসলামী লাইফ।

সম্পদ হিসেবে যা আছে বর্তমান:

আলফা ইসলামী লাইফের সবশেষ হিসাব সমাপনী বছর ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন খাতে কোম্পানিটির বর্তমান বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি খাতে বিনিয়োগ রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

বীমা গ্রাহক সংখ্যা:

বর্তমানে কোম্পানিটির সচল পলিসির সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৯টি। তবে ২০১৯ সালে সর্বমোট নতুন প্রিমিয়াম আয়ের হিসাবে ৮টি বীমা পরিকল্পের নতুন গ্রাহক সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৩৩২। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ৬ বছরে কোম্পানিটি যে পরিমাণ প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে তার গ্রাহকও রয়েছে। এর মধ্যে কিছু গ্রাহক প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম দিয়ে বাদ দিয়েছে। আর কিছু গ্রাহক রয়েছেন যারা দু’বছরের বেশি প্রিমিয়াম জমা দিয়েছেন। বিধান অনুসারে এসব গ্রাহকের দায় কোম্পানিটিকে বহন করতে হবে।

ব্যবসা নিয়ে যা বললেন মূখ্য নির্বাহী:

আলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবসায়িক অবস্থা নিয়ে কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা এম সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কোন মন্তব্য করতে পারবেন না বলে জানান।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাজারে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো সাধারণত ১০, ১২, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদী বীমা পলিসি ইস্যু করে থাকে। পলিসি ক্রয়ের সময় গ্রাহক প্রথম বছর যে প্রিমিয়াম জমা করেন তাকে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম বলা হয়ে থাকে। পরবর্তী বছরের প্রিমিয়ামগুলোকে নবায়ন প্রিমিয়াম বলা হয়। বিধান অনুসারে দু’বছরের প্রিমিয়াম জমা হলেই মেয়াদ শেষে লাভসহ তা গ্রাহককে ফেরত দিতে হবে।