যে মামলায় জেল হাজতে হোমল্যান্ড লাইফের লন্ডন প্রবাসী ৭ পরিচালক

নিজস্ব প্রতিবেদক: হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের লন্ডন প্রবাসী ৭ জন পরিচালককে গত ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে কোম্পানির প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে মতিঝিল থানা। ওইদিন গ্রেফতারকৃত আসামিদের কেরাণীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে পাঠানো হয়। সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) তাদের জামিন আবেদন করা হলেও তা নাকচ করেছেন আদালত। আগামী বৃহম্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) মাগুরার আদালতে আসামিদের হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

গ্রেফতারকৃত আসামিরা হলেন- হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, পরিচালক আবদুর রব, পরিচালক কামাল মিয়া, পরিচালক আবদুর রাজ্জাক, পরিচালক আবদুল আহাদ, পরিচালক জামাল উদ্দিন এবং পরিচালক আবদুল হাই।

গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধ না করার মামলায় এবারই কোন বীমা কোম্পানির ৭ জন পরিচালক জেল হাজত আছেন। ফলে এ ঘটনা বীমা খাতে এখন ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

প্রায় ১৪ লাখ টাকার বীমা দাবি না দেয়ায় হোমল্যান্ড লাইফের এই ৭ পরিচালকের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা করেন মাগুরা জেলার ৪ জন গ্রাহক। মামলার এজাহারে তারা নিজেদের কোম্পানির গ্রাহক হিসেবে দাবি করেন। মামলার বিষয় নিয়ে ৩ জন বাদীর সাথে আলাপ হয়েছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র।

যা বলছেন মামলার বাদীরা:

মামলার বাদী আজর আলী নিজে হোমল্যান্ড লাইফের একজন পলিসি হোল্ডার। সেই সাথে তিনি কোম্পানিটির একজন এজেন্টও। তার মামলা নং-২২৭/২২।   গত ২ আগস্ট তিনি এই মামলা দাযের করেন। এ মামলায় ১৯ জন সাক্ষীর সবাই বীমা গ্রাহক।

আজর আলী ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, অনেক দিন আগে আমাদের পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু কোম্পানি টাকা দিচ্ছে না। কোম্পানির কর্মকর্তাদের আমরা বারবার যোগাযোগ করেছি, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তারা আমাদের টাকা দেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে মামলা করেছি। সমাজে আমাদের একটা পরিচিতি আছে, সেটার কারণেই গ্রাহকরা আমাদের কাছে বীমা পলিসি করেছে। এখন আমরা তাদের সামনে যেতে পারি না। কোম্পানির কাছ থেকে টাকা না পেয়ে অনেককেই আমার পকেট থেকে টাকা দিয়েছি।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আজর আলী বলেন, আমরা কোম্পানির সবাইকে চিনি না এবং তাদের নামও জানি না। যে কয়জনের নাম জানতে পেরেছি তাদের নামে মামলা করা হয়েছে। কোম্পানির এমডি, চেয়ারম্যান কে তাও আমরা জানি না। শুনেছি কোম্পানিতে এখন নতুন এমডি এসেছেন। তবে তার নাম জানি না।

অপর একটি মামলা বাদি নায়েব আলী। তার মামলা নং ২২৮/২২। নায়েব আলীর পাওনা ১০ হাজার ৫০৬ টাকা। পলিসি নং-এ-৪৫০০০০২৬০৯-৬। এই মামলায় সাক্ষী ১৫ জন। তারা সবাই বীমা গ্রাহক। তাদের মোট পাওনা ২ লাখ ৪৯ হাজার ২৬৬ টাকা। নায়েব আলীর বাড়ি মাগুরা জেলার সদর থানার সত্যপুরে।

ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে নায়েব আলী বলেন, মানুষের (বীমা গ্রাহক) অত্যাচারে টিকতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে আমরা মামলা করেছি। আমাদের ৪ মামলার গ্রাহকদের পাওনা প্রায় পনের লাখ টাকা। ২০১৫ সালের পর থেকেই আমাদের অনেক গ্রাহকের বীমার মেয়াদ শেষ হয়েছে। প্রথম দিকে আমাদের গ্রাহকরা টাকা পেয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তারা গ্রাহকদের টাকা দিচ্ছে না।

নায়েব আলী বলেন, আমার বয়স হয়েছে। এই সময়ে এসে মানুষের কথা শুনতে খারাপ লাগে। গ্রাহকরা মনে করে তাদের টাকা আমরা নিয়েছি। বীমা কোম্পানির কাছে অনেক ঘুরেছি টাকার জন্য। কিন্তু কাজ হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই আমরা মামলা করেছি। আমাদের টাকা পরিশোধ করলে মামলার প্রয়োজন হতো না।

গ্রেফতারকৃত পরিচালকদের জামিন শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন উল্লেখ করে নায়েব আলী বলেন, বিচারক আসামিদের আইনজীবীর কাছে জানতে চান যে, তারা গ্রাহকদের কেন টাকা দিচ্ছেন না। টাকা ফেরত না দিলে কোন কথা চলবে না বলেও বিচারক মন্তব্য করেন বলে জানান নায়েব আলী।

হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আরেক মামলার বাদী সৈয়দ মোফাক্কার আলী রিন্টু। প্রায় ৪ লাখ টাকা বীমা দাবি আদায়ের জন্য মামলা করেন। মামলা নং-২২৯/২২। এই মামলায় স্বাক্ষী ৩৯ জন গ্রাহক। এর মধ্যে ২৩ জন গ্রাহকের পাওনা টাকা কত তার কোন হিসাব দেয়া হয়নি মামলার এজাহারে। 

সৈয়দ মোফাক্কার আলী রিন্টু ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, হোমল্যান্ড লাইফে কাজ করতে গিয়ে আমি কয়েকশ’ গ্রাহক তৈরি করেছি। তাদের অনেকের টাকা পেয়েছে। আগে গ্রাহকরা ঠিকমতো টাকা পেলেও এখন আর তারা টাকা পাচ্ছে না। গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে আমি হোমল্যান্ড ছেড়েছি। নিজে তো বীমায় কাজ করবই না, এমনকি অন্য কাউকেও আমি বীমা কাজ করতে বারণ করি।

তিনি বলেন, হোমল্যান্ড লাইফ আমার গ্রাহকদের বীমার টাকা ফেরত দিলে আমি বেঁচে যাই। আমার অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, মানুষের সামনে যেতেও পারি না। সবাই টাকার জন্য আমাকে ধরে। গ্রাহকদের এই ৩/৪ লাখ টাকার জন্য বাধ্য হয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছি।

সৈয়দ মোফাক্কার আলী বলেন, অনেক দিন ধরেই আমি কোম্পানিতে নেই। তাই এখন কে চেয়ারম্যান, আর কে এমডি তাও জানি না। যাদের নাম জানা ছিল তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করেছি। টাকা পাওয়াটাই কথা।

৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫৮ টাকার বীমা দাবি পরিশোধ না করায় মো. হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-২৩০/২২। এই মামলাতেও ৪৫ জন সাক্ষী। এজাহারে বলা হয়েছে বাদী ও সাক্ষী সকলেই বীমা গ্রাহক।

উল্লেখ্য, এর আগে ২০১০ সালে হোমল্যান্ড লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান সিলেটের কাজী এনাম উদ্দিন আহম্মদের ছেলে আরাফাত কাজী আহম্মদ চেক প্রতারণার এক মামলায় ৬ মাসের জেল খাটেন। পরে জামিন নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে যান। বর্তমানেও আরাফাত কাজী আহম্মদ লন্ডনে পলাতক।

হোমল্যান্ড লাইফের কাছ থেকে জমি বিক্রির বায়না বাবদ টাকা নিয়ে পরে জমি রেজিস্ট্রি ও বায়নার টাকা ফেরত না দেয়ার মামলায় আরাফাত কাজী আহম্মদকে ১ বছর বিনাশ্রম কারদণ্ড দেন ঢাকার যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ৫ম আদালত। ২০১০ সালের ১০ মার্চ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ ৫ম আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ওয়ালিউল ইসলাম এই আদেশ দেন।