রংপুর অফিসের পুরনো আসবাবপত্র সরাতে গিয়ে গ্রাহকদের বাধার মুখে ফারইস্টের কর্মকর্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক: রংপুরে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পুরনো আসবাবপত্র সরানোকে কেন্দ্র করে গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে উত্তেজনা ও বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। শনিবার (২৫ অক্টোবর) কোম্পানির অফিস থেকে পুরনো আসবাবপত্র ট্রাকে করে সরানোর সময় খবর পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা সেখানে জড়ো হয়ে বাধা দেন। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ বীমার অর্থ না পাওয়ায় তারা মালামাল আটকে দিয়েছেন। অপরদিকে, কোম্পানির কর্মকর্তারা দাবি করেন, নতুন অফিসে স্থানান্তরের অংশ হিসেবে পুরনো জিনিসপত্র বিক্রি করা হচ্ছিল। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং রোববার সকালে তারা রংপুরের গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নামেন।
সূত্রে জানা যায়, শনিবার অফিস থেকে পুরাতন আসবাবপত্র ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে স্থানীয় গ্রাহকরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ট্রাক আটকে দেন এবং জোনাল অফিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) আব্দুল কাদের বীরকে অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
পরদিন সকালে উত্তেজিত গ্রাহকরা দাবি জানান, বছরের পর বছর কিস্তি পরিশোধ করেও তারা কোনো টাকা পাননি, অথচ অফিস খালি করে মালামাল পাচারের চেষ্টা চলছে।
চোখে না দেখা এক নারী গ্রাহক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার বীমার মেয়াদ ছিল চার বছর, এখন ১৬ বছর ঘুরছি- এক টাকাও পাইনি। আমার মতো মানুষের কষ্টের টাকাটা যেন সরকার দ্রুত ফেরত দেয়।’
আরেক গ্রাহক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের টাকাগুলো ফেরত না দিয়ে অফিস খালি করা হচ্ছে। পাওনা না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই সরাতে দেয়া হবে না।’
অন্য এক নারী গ্রাহক বলেন, ‘আমাকে ভুল বুঝিয়ে পুরনো টাকার সঙ্গে নতুন পলিসি করে দিয়েছে, কিন্তু এখনো এক টাকাও ফেরত পাইনি।’
অন্য আরেক গ্রাহক জানান, ‘স্ত্রী অসুস্থ থাকার কথা জানিয়েও টাকা চাইলে কোনো সাড়া পাইনি। আমরা গ্রামের মানুষ, আমাদের সঙ্গে প্রতারণা হচ্ছে।’
এ ঘটনায় জোনাল অফিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাদের বীর বলেন, ‘পুরনো ফার্নিচার বিক্রি করে নতুন অফিসে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া চলছিল। এতে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমাদের যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে, যা বিক্রি করে ২০২৬ সালের মধ্যে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।’
রংপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) রমিজ আলম জানান, ‘এই জোনাল অফিসের আওতায় প্রায় ৭০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন, যাদের বকেয়া পাওনার পরিমাণ প্রায় ১৩৭ কোটি টাকা। কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলধন সংকটের কারণে বিলম্ব হচ্ছে, তবে সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে টাকা ফেরত দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুততম সময়ে গ্রাহকদের পাওনা ফেরতের ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অর্থ আত্মসাতের মামলায় গ্রেফতার হওয়া সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সুষ্ঠু বিচার ও আত্মসাতকৃত অর্থ উদ্ধার দাবিতে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ক্ষতিগ্রস্ত বীমা গ্রাহকরা ২৪ ও ২৬ অক্টোবর দু’দফায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।
এ সময় তারা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মহাপরিচালকের বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করে আত্মসাতকারীদের দেশ-বিদেশে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে কোম্পানির কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি, আত্মসাতে সহযোগীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও জোর দাবি তোলেন তারা।
উল্লেখ্য, জমি ক্রয় দেখিয়ে অর্থ আত্মাসাতের মামলায় ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একইদিন তাকে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে হাজির করা হলে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত ৩১ জুলাই ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের নামে রাজধানীর ৩৬ তোপখানায় ২০৭ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার জমি ক্রয় দেখিয়ে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ৪৫ কোটি টাকা আত্মাসাৎ করে। এর মধ্যে নজরুল ইসলাম আত্মসাৎ করেন ১০ কোটি ও তার স্ত্রী এবং ফারইস্ট লাইফের সাবেক পরিচালক তাসলিমা ইসলাম আত্মসাৎ করে সাড়ে ৯ কোটি। জমি ক্রয় ও অর্থ আত্মসাতের এ ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে।
মামলার আসামিদের মধ্যে পরিচালক নাজনিন হোসেন এখনো পরিচালনা পর্ষদে আছেন। মামলার অপর আসামি মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডা. মো. মনোয়ার হোসেনের বড় ভাই ড. মোকাদ্দেস হোসেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়াও ড. মোকাদ্দেস হোসেনের আরেক ভাই মোজাম্মেল হোসেনও দুদকের অপর মামলার আসামি। ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের নিরপেক্ষ পরিচালক হিসেবে আছেন মোবারক হোসেনের ভাই মামলার অপর আসামী আমানত শাহ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. হেলাল মিয়া।
মামলার অন্য আসমিরা হলেন- পিএফআই প্রোপার্টিজ ও নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক শাহরিয়ার খালেদ, গেটকো টেলিকমিউনিকেশন ও গেটকো এগ্রো ভিশনের চেয়ারম্যান কে এম খালেদ, প্রাইম ব্যাংক ও প্রাইম ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা এবং ম্যাক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টি এম এ খালেক, টারটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ড. ইফফাৎ জাহান, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক খন্দকার মোস্তাক মাহমুদ, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান, মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক রাবেয়া বেগম, স্বতন্ত্র পরিচালক ও আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন এবং স্বতন্ত্র পরিচালক ও পিএফআই সিকিউরিটিজের সাবেক এমডি কাজী ফরিদ উদ্দীন আহমেদ। কোম্পানিটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্যাহ-কেও দুদকের মামলার আসামি করা হয়।
এর আগে, ২০২০ সালে ২৪ জুন ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাড়ে ১৪ কোটি টাকার জমিতে বালু ফেলতেই খরচ ১৪২ কোটি টাকা শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। এতে তদন্তে নামে আইডিআরএ।
গত ২৫ এপ্রিল ২০২১ তারিখে তদন্তকারী হিসেবে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস সিরাজ খান বসাক এন্ড কো. কে নিয়োগ করা হয়। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের ১৮ মে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
সিরাজ খান বসাক এন্ড কোম্পানির তদন্তে ফারইস্ট লাইফের ২ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার তহবিল তসরুফের তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা তসরুফ করা হয়েছে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে জমি ক্রয় ও উন্নয়ন দেখিয়ে, এমটিডিআর বন্ধক রেখে পরিচালক ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া এবং ক্ষতিকর বিনিয়োগ করে। বাকি ৪৩২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা তসরুফ করা হয়েছে পরিচালনাগত ত্রুটি ও অনিয়ম করে।
এ বিপুল পরিমাণ টাকা তসরুফের জন্য দায়ী করা হয় বীমা কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামসহ সকল পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী হেমায়েত উল্লাহকে। এ ঘটনায় ফারইস্ট লাইফের তহবিল তসরুফের ঘটনায় এর আগেও দুর্নীতি দমন কমিশন আরো তিনটি মামলা দায়ের করেন।
তবে এসব মামলায় ফারইস্টের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক পরিচালক এম এ খালেক ছাড়া অপর কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি।

 (1).gif)


