লুটপাটের উর্বর খাত ক্ষুদ্রবীমা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশের বীমাখাতকে এগিয়ে রেখেছে ক্ষুদ্রবীমা প্রকল্প। এ প্রকল্পের উপর ভর করেই এতোদূর এসেছে বীমা খাত। কিন্তু কোম্পানিরগুলো অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, অতিলোভী মনোভাব, মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ না করা, এমনকি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উদাসিনতায় থমকে গেছে গ্রামীণ মানুষের জনপ্রিয় প্রকল্প ক্ষুদ্রবীমা। এক কথায় লুটপাটের উর্বর জায়গায় পরিণত হয়েছে বীমা খাতের এ প্রকল্পটি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে ক্ষুদ্র বীমার প্রচলন হয়। কিন্তু স্বাবলম্বী তো দূরে থাক, তাদের কষ্টে অর্জিত অর্থ ফেরৎ পেতে নানা ভোগান্তির অভিযোগ উঠে এসেছে। এ প্রকল্পে কোম্পানি ও কোম্পানির মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা লাভবান হলেও দরিদ্র গ্রাহকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।

বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা পলিসি বিক্রির বিষয়টি এক ধরনের পুশিং সেল। এখানে একজন গ্রাহককে নানা কৌশলে বীমার পলিসি কেনার জন্য আগ্রহী করে তোলা হয়। ফলে কোনো কারণে গ্রাহকের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য না হলে গ্রাহক প্রিমিয়াম দিতে পারেন না। তাছাড়া বীমা পলিসি বিক্রি করে এজেন্ট। আগে একজন এজেন্ট প্রথম কিস্তিতে কমিশন পেতেন ৩৫ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত (বর্তমানে তা ১৫ শতাংশ) ।

অথচ আইন অনুসারে দ্বিতীয় বছর থেকে পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত কমিশন ৫ শতাংশ। এর পরের বছরগুলো এজেন্ট কোনো কমিশন পান না। ফলে নবায়নকৃত প্রিমিয়াম আদায়ে এজেন্টের কোনো আগ্রহ থাকে না। আবার ক্ষুদ্র বীমার কোনো গ্রাহকই নিজ থেকে প্রিমিয়াম দেন না। কোম্পানির গিয়ে আনতে হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এজেন্টরা নয়-ছয় করে। তাদের কারণেই মূলত ক্ষুদ্র বীমার পলিসি নষ্ট হয়।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী বলছেন, বীমা প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্ষুদ্রবীমা প্রকল্প। গ্রামের অতি দরিদ্র মানুষের টাকা নিয়ে কোম্পানিগুলো তাদের সম্পদ তৈরি করছে। অথচ সেই সব মানুষের কথা চিন্তা করছেন না কোম্পানির কর্তৃপক্ষরা।

তারা বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে ১০০ টাকা পলিসি নিয়ে মেয়াদ শেষে দ্বিগুণ লাভের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এই ১০০ টাকার ৭০ থেকে ৮০ টাকা বিভিন্নভাবে খরচ করেন কর্তৃপক্ষ। বাকি ২০/৩০ টাকা বিনিয়োগে কাজে লাগান। এই সামান্য বিনিয়োগ থেকে মুনাফা দ্বিগুণ হওয়া সম্ভব নয়। তাই মেয়াদ শেষে কখনো দিগুণ মুনাফা দেয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন প্রধান নির্বাহীরা।

মূখ্য নির্বাহীরা আরো বলেন, সব ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র বীমায় জবাবদিহীতা কম। এজেন্টরা নিজের স্বার্থে গ্রামীণ জনপদের সহজ সরল মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে বীমার আওতায় আনে। তাদের দ্বিগুণ লাভ, জমাকৃত টাকার উপর ঋণের ব্যবস্থাসহ নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে বীমা পলিসি খুলতো। পরে এসব ক্ষুদ্র বীমার গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা এনে এজন্টরা ইচ্ছে মতো খরচ করে ফেলতো। কোম্পানির কাছে তাদের জবাবদিহিতা নাই বললেই চলে। স্থানীয় পর্যায়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী না হওয়ায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। মাঠ পর্যায়ের কর্মী বা এজেন্টদের কারণেই ক্ষুদ্রবীমায় বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে বলে জানান তারা।

এ প্রসঙ্গে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী আজিজুল ইসলাম তালুকদার ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, ক্ষুদ্রবীমা মূলত গ্রামের সহজ সরল ও দরিদ্র লোকেরাই করেন। তাদেরকে মাঠ পর্যায়ের কর্মী অর্থাৎ কোম্পানি এজেন্টরা উল্টাপাল্টা বুঝায়। গ্রাহকদের তারা ব্যাংকে টাকা রাখার কথা বলে বীমার আওতায় আনে। প্রথমে তাদেরকে বীমার কথা বলে না। প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে তারা নিজেরাই খরচ করে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ক্ষুদ্রবীমা মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের জন্য লুটপাটের উর্বর জায়গা। এর কারণ হলো সংশ্লিষ্ট এজেন্টরাও বীমা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। বীমা সম্পর্কে তাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। অজ্ঞতার কারণেই তারা গ্রাহকদের ভুল ম্যাসেজ দেন। এর প্রভাব অটোমেটিকভাবে এক পর্যায়ে কোম্পানির উপর চলে আসে।

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী অজিৎ চন্দ্র আইচ বলেন, সমাজের দরিদ্র মানুষকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে এগিয়ে নিতে ক্ষুদ্র বীমা চালু করা হয়। তাদের টাকা দিয়ে কোম্পানিগুলো অনেক কিছু করলেও গ্রাহকের মুনাফা দেয়ার বেলায় যতো আপত্তি। এতে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকসহ ওই এলাকার সব মানুষের মধ্যে বীমা সম্পর্কে নেতিবাচবক ধারণা তৈরি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ক্ষুদ্র বীমার ১০০ টাকার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করতে যে সময় ও জনবল লাগে ১০ হাজার টাকার প্রিমিয়ামেও একই সময় ও জনবল লাগে। ফলে ক্ষুদ্র বীমার চেয়ে বর্তমানে একক বীমায় সবার চোখ বলে তিনি মন্তব্য করেন।

মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী মো. শাহ আলম এফসিএ ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, ক্ষুদ্রবীমা লাভজনক পলিসি না। প্রিমিয়াম শুরু হয় মাত্র ৫০টাকা থেকে। এতে কাগজ খরচের টাকাও ওঠে না। কোনো গ্রাহকই নিজ থেকে প্রিমিয়াম জমা দেন না। মাসে মাসে কর্মীদের কালেকশন করতে হয়। এতে এজেন্টদের লাভ কম। এজেন্টদের না পোশানোর কারণে প্রিমিয়াম কালেকশন করতে অনিহা দেখায়। অনেক সময় কলেকশন করা টাকা কোম্পানিতে জমা না দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো খরচ করে। জবাবদিহিতা না থাকায় তারা এ ধরনের কাজ করতে সাহস পায়। এতে কোম্পানির বদনাম হয় অন্যদিকে গ্রাহকদের ঝুঁকি বাড়ে।

যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল বলেন, কেবল মাত্র সচেতনতার অভাবে ক্ষুদ্রবীমা উঠতে পারছে না। গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠি এমনিতেই অসচেতন, তারপরেও কোম্পানিগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বীমা সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। ফলে স্থানীয় এজেন্টরা তাদেরকে আরো উল্টা-পাল্টা তথ্য দিয়ে পলিসি খোলেন। এতে বীমা খাতে দারুণ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এরমধ্যে কালেকশন প্রক্রিয়া অনেক জটিল। প্রিমিয়াম কম। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কমিশনও অনেক কম। তাছাড়া ঝামেলা বেশি হওয়ায় এসব কর্মীরা গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা তুলে আত্মসাৎ করে। তা ছাড়া একক বীমার তুলনায় ক্ষুদ্র বীমায় কোম্পানি তেমন লাভ করতে পারছে না। এতে গ্রাহকদেরও তেমন লাভ দিতে পারছে না।

তিনি আরো বলেন, ক্ষুদ্রবীমার ১০০ টাকার পলিসিতে ৭০ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। বাকি ৩০ টাকা বিনিয়োগ করে কোম্পানি কি লাভ করবে আর গ্রাহকরেদরও বা কি লাভ দিবে। এর প্রভাবও বীমা বাজারে পড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এমনকি গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুদ্রবীমার এ পলিসিতে গ্রাহককে অধিকাংশ কোম্পানি কোনো মুনাফা দিতে পারেনি। দু’একটি কোম্পানি নামে মাত্র মুনাফা দিচ্ছে। এ মুনাফার হারও ১০ বছর পর ১০ হাজার টাকায় ১/২ হাজার টাকা। মোট জমা দেয়া টাকাও ফেরত পাচ্ছে না এমন অভিযোগ রয়েছে দেশের অনেক এলাকার গ্রাহকদের।

গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী সুশান্ত প্রামাণিক ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কারণেই ক্ষুদ্রবীমায় সুস্থ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না কোম্পানিগুলো। গ্রাহকদের টাকা সংগ্রহ করে কোম্পানিতে তা জমা না দিয়ে আদায়কৃত টাকা আত্মসাৎ করে। কোম্পানিকে হিসাব দেয়ার সময় নয়-ছয় করে। এতে গ্রাহকদের কোনো হাত না থাকলেও এর ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট গ্রাহকরাই। কারণ ক্ষুদ্রবীমার ক্ষেত্রে কোনো মাসের প্রিমিয়াম জমা না হলে ওই মাসের ঝুঁকি থেকে বঞ্চিত হয় ওই গ্রাহক। এতে কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী কোন দোষ না থাকলেও গ্রাহকরা এর দায় চাপান কোম্পানির উপর।