প্রথম বর্ষ ও নবায়নে কমিশন হার একই হওয়া উচিত: বিশ্বজিৎ কুমার

বাংলাদেশের ক্ষুদ্রবীমার সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে বিশেষ আয়োজন করেছে দেশের প্রথম এবং একমাত্র বীমা ভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। বিশেষ আয়োজনের এ পর্বে থাকছে ক্ষুদ্রবীমার ওপর মূখ্য নির্বাহীদের অভিমত। যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল’র এই অভিমত নিয়েছেন আবদুর রহমান। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য অভিমতটি তুলে ধরা হলো:

যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্রবীমা ভাল, যদি আমরা সামাজিক খাতে সেভাবে কাজে লাগাতে পারি। গরীব জনগোষ্ঠিকে এর আওতায় আনা উচিত এবং এদের জন্য আলাদভাবে কাজ করা উচিত। বিশেষ করে যারা ট্যাক্স দেয় তাদেরকে বাদ দিয়ে গরীব জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রবীমার আওতায় আনা উচিত। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্রবীমার মাসিক কিস্তি হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা।

তিনি বলেন, ক্ষুদ্রবীমার জন্য আমরা আগে আলাদা কমিশন বা শিডিউল করতাম। এতে ক্ষুদ্রবীমার জন্য এভারেজ কমিশন অর্থাৎ নবায়নের জন্য যে হারে কমিশন দিতাম প্রথম বর্ষের জন্যও একই হারে কমিশন দিতাম। তবে একক বীমার জন্য প্রথম বর্ষে বেশি কমিশন এবং নবায়নে কম। বর্তমানে বীমা আইনের কারণে একক বীমার ক্ষেত্রে যে হারে কমিশন দেয়া হয়, ক্ষুদ্রবীমার জন্যও একই হারে কমিশন দেয়া হয়। ফলে একক বীমা ও ক্ষুদ্রবীমার মধ্যে কোন পার্থক্য মনে হয় না।

নবায়নের চেয়ে প্রথম বর্ষের কমিশন বেশি হওয়ায় প্রতিনিধিরা প্রথম বর্ষের কিস্তি সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব দেয় বেশি। আর নবায়ন গুরুত্ব না পাওয়ায় গ্রাহকের পলিসি ল্যাপস হয়ে যায়। তাই ক্ষুদ্রবীমাকে এগিয়ে নিতে চাইলে প্রথম বর্ষ ও নবায়নে একই হারে কমিশন দিতে হবে। কারণ, পলিসি শতভাগ ম্যাচ্যুরিটি না হলে গ্রাহক পুরো টাকা পায় না। আর দু’বছর পূর্ণ না হলে গ্রাহক কোন টাকাই ফেরত পায় না। এতে করে গ্রাহকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যার প্রভাব পুরো খাতের ওপর পড়ে।

ক্ষুদ্রবীমা দাবিতে কোম্পানিগুলো মুনাফা দিতে না পারার বিষয়ে বিশ্বজিৎ কুমার বলেন, এই বীমায় খরচ এবং ল্যাপসের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কোম্পানিগুলো বেশি লাভ দিতে পারছে না। কারণ, প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম সংগ্রহে ৯০ শতাংশের বেশি খরচ হয়ে যায়। প্রথম বর্ষেই পুরো এক বছরের কমিশন দিতে হয়। তাছাড়া ব্যবস্থপনা ব্যয় তো আছেই। দ্বিতীয় বছর বা ১৩তম কিস্তি থেকে আবার কমিশনের পরিমাণ কমে আসে। এজন্য সরকারকে ক্ষুদ্রবীমা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি ব্যয়ের সীমা আরে কমিয়ে আনা উচিত।

তিনি জানান, গ্রামীন বা সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসার দায়বদ্ধতায় বলা হয়েছে, লাইফ বীমায় প্রথম বছরে কমপক্ষে ১ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে ৩ শতাংশ, তৃতীয় বছরে ৬ শতাংশ, চতুর্থ বছরে ৯ শতাংশ ও পঞ্চম বছরে ১২ শতাংশ ক্ষুদ্রবীমার প্রিমিয়াম হতে হবে। অর্থাৎ প্রথম বছরে যদি ১০০ টাকা প্রিমিয়াম আসে তাহলে ১ টাকা হতে হবে ক্ষুদ্রবীমার। এটা পরিবর্তন করা প্রয়োজন।  সামাজিক খাতে বীমা ব্যবসা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। যেকোন কোম্পানির গ্রস প্রিমিয়ামের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষুদ্রবীমার হওয়া উচিত। তবে শুধু বাড়ালেই হবে না, কমিশন নীতিমালাও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অনুমোদিত সীমাও কমিয়ে আনতে হবে।

ক্ষুদ্রবীমার মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণের গুরুত্ব তলে ধরে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও বিশ্বজিৎ বলেন, ৯৯ শতাংশেরও বেশি মাঠকর্মী গ্রাহকদের ভুল বুঝায়। তারা গ্রাহককে বলে, আপনি যে টাকা জমা দেবেন এক বৎসর পর আপনার পুরো টাকা ফেরত দেয়া হবে। আবার ১০ বছরে দ্বিগুণ টাকা দেয়া হবে বলেও জানায়। কিছুটা বুঝে মিথ্যা বলে, কিছুটা না বুঝে মিথ্যা বলে তারা পলিসি করায়।এজন্য তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষিত হওয়া উচিত এবং বীমা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। গ্রাহকে কি কি বিষয় জানাতে হবে সেগুলো তাদের জানতে হবে। মূলত প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।

তিনি আরো বলেন, ক্ষুদ্রবীমায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থানের তুলনায় আমাদের কিছুই নেই। তারা যত তাড়াতাড়ি এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে আমরা তা পারি না। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে তারা কাজ শুরু করে এবং আস্তে আস্তে সেটা প্রতিষ্ঠা করে। আমাদেরও সেরকম হওয়া উচিত। প্রতিটি কোম্পানিতে ক্ষুদ্রবীমাকে আলাদাভাবে নজর দেয়া উচিত। এর জন্য আলাদা উইং বা শাখা করে কাজ করা উচিত। বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) মতো গ্রামে গ্রামে কাজ করা উচিত। গ্রামের মানুষ এখন সচেতন। এনজিও কর্মীরা তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তুলেছে।

যমুনা লাইফের সিইও বলেন, বিদেশি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে থাকে, তবে তা খুবই কম। বেশিরভাগ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশের বাইরে যায় কিন্তু শিখে আসে না। শুধুমাত্র গর্ব করে বলার জন্যই বেড়াতে যায়। আবার সিইও’রা বাইরে ঘুরতে গেলেও জুনিয়রদের পাঠাতে চায় না। তিনি আরো বলেন, আমাদের সিইও’দের উচ্চ শিক্ষা কম। বিশেষ করে বীমার ওপর শিক্ষা নেই বললেই চলে। দেশের বাইরে সিইও’দের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। ২/১টি ছাড়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের সিনিয়র কর্মকর্তাদের শিক্ষার জন্য খরচ করতে চায় না। এর পরিবর্তন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

ক্ষুদ্রবীমার ওপর বিশেষ কোন প্রশিক্ষণ না থাকলেও বীমার ওপর প্রোফেশনাল ডিগ্রি কোর্স সম্পন্ন করেছেন বলে জানান বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির এই কোর্সে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। বর্তমানে তিনি চার্টার্ড ইন্স্যুরেন্স ইন্সটিটিউট অব লন্ডন এ অধ্যায়ন করছে। এছাড়াও বেশ কিছু প্রফেশনাল ট্রেইনিং গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারতে ক্ষুদ্রবীমার পাইলট প্রকল্প দেখে এসেছেন বলেও জানান বিশ্বজিৎ কুমার।

প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে ক্ষুদ্রবীমা নিয়ে বিশেষ কোন পরিকল্পনা করতে পারছেন না বলে জানান যমুন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই মূখ্য নির্বাহী। তবে কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সরকার যদি ক্ষুদ্রবীমাকে বাধ্যতামূলক করে এবং প্রতিনিধিরা যদি ভালো প্রশিক্ষিত হয়ে আসতে পারে তাহলে এটাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া কোনভাবেই ক্ষুদ্রবীমাকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয় বলেও জানান বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল।

প্রকাশের তারিখ- ১৬ জুন, ২০১৬