কর্মীদের আগে সিইও’দের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন: অজিত চন্দ্র আইচ

বাংলাদেশের ক্ষুদ্রবীমার সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে বিশেষ আয়োজন করেছে দেশের প্রথম এবং একমাত্র বীমা ভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। বিশেষ আয়োজনের এ পর্বে থাকছে ক্ষুদ্রবীমার ওপর মূখ্য নির্বাহীদের অভিমত। সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অজিত চন্দ্র আইচ’র এই অভিমত নিয়েছেন আবদুর রহমান। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য অভিমতটি তুলে ধরা হলো:

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) অজিত চন্দ্র আইচ বলেন, ক্ষুদ্রবীমা স্বল্প আয়ের লোকজনের জন্য মাসিক পদ্ধতিতে ১০০ বা ২০০ বা ৫০০ টাকার প্রিমিয়ামের বীমা। সমাজের দরিদ্র মানুষকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রথম ডেল্টা লাইফে ক্ষুদ্রবীমা চালু করেন শাফাত আহমেদ চৌধুরী। তখন এর নাম ছিল গণবীমা। পলিসির বিপরীতে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ চালু করা হয়। তখন এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো মানুষ ঋণ নিয়ে আর টাকা ফেরত দেয় না। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে এটা বন্ধ করে দেয়া হয়।

অজিত চন্দ্র বলেন, সন্ধানী লাইফে থাকা অবস্থায় আমি প্রথম ডিপিএস নামে বীমা চালু করি। উত্তরবঙ্গ ঘুরে আমি দেখতে পাই যাদের বীমা করা প্রয়োজন তারা বীমা করতে পারছে না। রিকশাওয়ালা, দিনমজুর ইত্যাদি যাদের বেশি টাকার বীমা করা সম্ভব নয় কিন্তু ৫০ বা ১০০ টাকা চেষ্টা করলেই জমা করতে পারে, তাদের জন্য এই বীমা। বিষয়টি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছে। আমি বলেছি, ডিপিএস একটি সর্বজন গ্রহণযোজ্য নাম। ব্যাংক ডিপিএস চালু করলেও তারা শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা দেয়। আর বীমা কোম্পানি অর্জিত বোনাস যোগ করে মুনাফাসহ ১০ বছর পরে গ্রাহককে টাকা দেয়। পাশাপাশি ঝুঁকিও বহন করে বীমা কোম্পানি। ২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ সালের দিকে সরকারি ব্যাংকগুলো ডিপিএস বন্ধ করে দেয়। সব মিলিয়ে ডিপিএস বীমা গ্রাহকের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। এমনকি আলিকো’র বীমা কোম্পানিও এ পথে আসে। ক্ষুদ্রবীমার কারণে বেশি সংখ্যক মানুষ বীমার আওতায় এসেছে।

কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন নতুন কিছু কোম্পানি শুনে শুনে ক্ষুদ্রবীমা পলিসি চালু করে। মূলত তারা গ্রাহককে লাভ দিতে পারছে না। ঘটনাটা হলো সেই রোগীর মতো, যাকে কবিরাজ বলেছিল বাসক পাতা খেলে কাশি ভালো হবে। কিন্তু রোগী ভুল শুনে বাঁশ পাতা খাওয়া শুরু করে। এতে রোগ তো ভালো হয় না বরং আরো বেড়ে যায়।নতুন এসব বীমা কোম্পানি মনে করেছিল ১০/১২ বছর পর গ্রাহক আর টাকা নিতে আসবে না। তাই প্রিমিয়াম কালেকশন করে ইচ্ছামতো খরচ করে এখন আর গ্রাহককে ভালো লাভ দিতে পারছে না।

ক্ষুদ্রবীমার খারাপ অবস্থার জন্য ২০০১ সালে অনুমোদন প্রাপ্ত কিছু নতুন কোম্পানি দায়ি। নতুন ১১ কোম্পানির মধ্যে ৮টি জরিমানা দিয়ে টিকে আছে।এজন্য প্রয়োজন সব কোম্পানিকে একই আইনের আওতায় নিয়ে আসা, একই কমিশন সিস্টেম চালু করা। আসল কথা হলো কাগজ-কলমে আইন আছে কিন্তু মানা হচ্ছে না। আইডিআরএ না থাকলে এই খাতের অবস্থা আরো খারাপ হতো। তবে যে উদ্দেশ্যে আইডিআরএ গঠন করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

সোনালী লাইফের এই সিইও বলেন, লাইফ ইন্স্যুরেন্স হচ্ছে একটি বট বৃক্ষের মতো। পরিচর্যা করে এটাকে বড় করা হলো ছোট-খাটো দু’একটি ঝড় সামলে নিতে পারে। কিন্তু এখন বড় হওয়ার আগেই গলাটিপে ধরা হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর অবস্থা হচ্ছে, ভাগযোগ করে খাওয়া। গ্রাহক টাকা নিতে আসলে নতুন পলিসি ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কোন আইনে নেই। আইডিআরএ এটা ধরতে পারছে না বা ধরছে না। একটাকে ঠিকমতো ধরতে পারলে অন্যরাও সোজা হয়ে যাবে। মূল কথা হলো, আইনের প্রয়োগ ও মানার অভ্যাস করতে হবে।  বর্তমানে বীমা শিল্পে ক্রান্তিকাল চলছে। আমরা হতাশ। এভাবে চলতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোতে দক্ষ ও শিক্ষিত লোকের অভাব। উপযুক্ত ব্যক্তিকে উপযুক্ত পদে বসানো হচ্ছে না। অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের হাতে কোম্পানি পরিচালনার ভার দেয়া হয়েছে। নতুন প্রডাক্ট সম্পর্কে যাদের কোনো ধরণা নেই। ব্যবসার উন্নয়নে তাদের পরিকল্পনাই নেই। কিন্তু তারা মোটা অংকের বেতন-ভাতা নিয়ে যাচ্ছে। এসব কোম্পানি তাদের গ্রাহককে মুনাফা দিতে পারছে না। এমনকি গ্রাহকদের দাবি পরিশোধেও তারা গড়িমসি করে। এতে মানুষের মধ্যে বীমা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়।

অজিত চন্দ্র বলেন, অনৈক বীমা কোম্পানিতে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষুদ্রবীমার প্রিমিয়াম আসে। ক্ষুদ্রবীমা চালু থাকলে মাঝে মধ্যে একক বীমার প্রিমিয়াম না আসলেও অফিস পরিচালনায় সমস্যা হয় না। তাই ক্ষুদ্রবীমার প্রতি জোর দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ক্ষুদ্রবীমাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ল্যাপস এর পরিমাণ কমাতে হবে। এজন্য গ্রাহককে প্রিমিয়াম প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক বাড়ানো সহজ কিন্তু পলিসি চালু রাখা কঠিন। যেকোন প্রোডাক্টের মিশন-ভিশন ঠিক রেখে সেবা নিশ্চিত করে গ্রাহকের আস্থা সৃষ্টি করা হলো মূল বিষয়।

ক্ষুদ্রবীমার মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে সোনালী লাইফের সিইও অজিত চন্দ্র আইচ বলেন, কর্মীদের আগে সিইও’দের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কাজ করতে করতে কর্মীদের অভিজ্ঞতা কম হচ্ছে না। কিন্তু তাদের পরিচালক যারা তাদের অভিজ্ঞতা কম। অনেক সিইও আছে যারা ক্ষুদ্রবীমা ভালো বোঝে না। এজন্য আগে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে নতুন দায়িত্ব নেয়া ও ভারপ্রাপ্ত সিইও’দের এক্সিউটিভ ট্রেইনিং দেয়া প্রয়োজন।

অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্রবীমার অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ল্যাপস কম, আমাদের বেশি। গ্রাহকের সঙ্গে কোম্পানির যোগাযোগ না থাকলে তাদের আগ্রহ কমে যায়। তবে সোনালী লাইফ এদিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। শতভাগ ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হয়। গ্রাহক টাকা জমা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ পায়। পরবর্তী প্রিমিয়ামের জন্য বারংবার মেসেজে দেয়া হয়। এতে অনেক সময় তারা বিরক্ত হয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, আমাদের ক্ষুদ্রবীমার স্ট্রাকচার ভালো। তবে নতুন করে কোন গবেষণা করে না। বেশিরভাগ সিইও ক্ষুদ্রবীমা বিষয়ে বোঝে না। তারা জানে শুধু প্রিমিয়াম আনা। সিইও’রা চেয়ারম্যানকে বোঝায় যে, ১০ বছর পর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ গ্রাহক আসবে টাকা নিতে। বাকী ৯০ শতাংশই আর আসবে না। তাই কিছু টাকা রেখে বাকীটা ভাগযোগ করে নেন। এই হলো আমাদের অবস্থা। এখানে কোন জবাবদিহীতা নেই।

ক্ষুদ্রবীমায় খরচ বেশি হওয়ায় গ্রাহককে প্রত্যাশিত মুনাফা দেয়া হয় না। অনেক কোম্পানির মালিক আছে যারা এখান থেকে টাকা নিয়ে অন্য আরো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। কিন্তু গ্রাহককে ঠিক মতো লাভ দেয় না। এখানকার টাকা এখানে ফিরিয়ে দিলেই গ্রাহকরা অনেক মুনাফা পাবে। অনেকে আছে গ্রাহক মারা গেলে ঠিকই টাকা দিচ্ছে কিন্তু বেঁচে থাকলে দিতে চায় না। কিন্তু তা হবে কেন, গ্রাহকের টাকা গ্রাহকে দিতে সমস্যা কোথায়।

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সর মূখ্য নির্বাহী অজিত চন্দ্র আইচ বলেন, ক্ষুদ্রবীমা নিয়ে বিশেষ কোন একাডেমিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি। তবে বেশ ক’টি দেশে সেমিনারে অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে জাপান, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। ২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ সালের দিকে এসব সেমিনার হয়েছে। তবে ইন্টারন্যাশনাল একচ্যুয়ারি সোসাইটি অব জাপান আয়োজিত সেমিনারে অনেক ভালো আলোচনা হয়েছে। সলভেন্সি মার্জিন, মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স প্রোডাক্টসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ১৫ দিনের ওই সেমিনারে। এধরণের সেমিনার-সম্মেলনে অংশ নেয়া আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন।

প্রকাশের তারিখ- ৩০ জুন, ২০১৬