করোনা ভাইরাসের প্রভাবে আতংকিত বিশ্ব অর্থনীতি
মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ: পৃথিবীতে অনেক বিচিত্র রোগ-বালাই আছে কিন্তু তা এক এক দেশে এক এক সময় আবির্ভূত হয়। একমাত্র করোনা ভাইরাস যা পৃথিবীর সকল দেশে সমভাবে আবির্ভূত হয়েছে। এর সংস্পর্শে যারা আসছেন তারাও সমভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এটা আসলে ছোঁয়াছে বা পরিবাহিত রোগ।
চীন দেশের উহান প্রদেশ থেকে এই কোবিড-১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি হয় অক্টোবর-২০১৯ এর শেষভাগে এরপর থেকে আস্তে আস্তে তিন মাসে পৃথিবীর সকল দেশ ও অঞ্চলে বীরদর্পে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস।
এই সময়ের মধ্যেই এই ভাইরাস আমাদের দেশেও হানা দিয়েছে আর তা আমাদের অসতর্কতার কারণেই। আমরা আমাদের স্থল এবং বিমান বন্দর খোলা রেখে মহানূভতা দেখিয়ে বিপদে পড়েছি। আমাদের বিদেশী ভাইদের দ্বারা আমরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছি অথচ তাদের ঘরে আবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকাকে বাধ্য হয়ে লক-ডাউন করতে হয়েছে। পরবর্তীতে আরো বিভিন্ন এলাকাও লক-ডাউন করতে হতে পারে। যা প্রমাণ করে করোনা ভাইরাসের আগ্রাসী মনোভাবের কাছে আমরা সবাই অসহায়।
করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাব থেকে বাঁচতে হলে দরকার সচেতনতা। আর রাষ্ট্র পক্ষই সচেতনতা সৃষ্টিতে সব চেয়ে বড় অবদান রাখতে পারে। সে দিক বিবেচনা করে সরকার সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী পালনের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করেছেন। এছাড়া আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও বন্ধ করেছেন।
চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে সামাল দিচ্ছে আমাদেরও সেপথে হাটতে হবে। ইতালি থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে ভাইরাসের পিছে নয় আগে হাটতে হবে। আমাদের পাশের ছোট দেশ নেপাল যে দেশে একজন করোনা রোগীর সংবাদ পাওয়ার পর কোয়ারেন্টিন-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে বিশাল এলাকা নিয়ে যা সত্যি প্রসংশনীয়। ভূটানও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ড্রামে/কনটেনারে করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাত ধোঁয়ার ব্যবস্থা করেছে ও রাস্তা ঘাট সর্বদা স্প্রে করে জীবানুমুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বেই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর কানাডার প্রেসিডেন্ট নিজের অবস্থান ছেড়ে বাড়ী বাড়ী সচেতনামূলক ব্যবস্থা তৈরীতে ব্যস্ত। তিনি বলেছেন আমার জনগণ ছাড়া আমার অস্তিত্ব কোথায়!
দেশের জনগন আজ করোনা ভাইরাসের আতংকে আতংকিত। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। নেতারা সুনির্দিষ্ট কোন দিক নির্দেশনা দিতে পারছেন না। শুধু আস্থা রাখতে বলছেন, মুখে মুখে বুলি আওড়াচ্ছেন। কিন্তু দীর্ঘ তিন মাসেও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা বা যারা চিকিৎসা দিবেন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, পরীক্ষার জন্য কীট বা হাসপাতাল বা কোয়ারেন্টিন এর জন্য যথাযোগ্য স্থান নির্ধারণ করতে পারেননি। বরং জনবসতি এলাকায় কোয়ারেন্টিন করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে।
বর্তমান অবস্থায় আমাদের অন্যতম বন্ধু চীন তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট ১০,০০০ (দশ হাজার) পরীক্ষার কীট ও পিপিই এবং ডাক্তার ও নার্স পাঠাচ্ছেন যারা এই ভাইরাস মোকাবেলায় পারদর্শী। একেই বলে সত্যিকারের বন্ধু। সরকারও পরীক্ষার জন্য আরো সাতটি স্থান, রোগীদের জন্য আরো দুটি হাসপাতাল এবং আইসিইউ বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে মাস্ক, টেস্ট কিট আর নিরাপত্তা পোশাক অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চীনের অনলাইনভিত্তিক খুচরা পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা।
আমাদের দেশেও অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ব্যাংককে দেউলিয়া বানিয়েছেন অথচ বিদেশীদের মতো নিজের দেশের এই করুন চিত্র দেখেও দেশের জনগনের জন্য কিছু একটা করার আগ্রহ বা উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না ভাবলে অবাক লাগে। গরীবের টেক্সের টাকায় তারা বড়োলোকি দেখাচ্ছেন, নিরীহ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে অথচ তাদের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না। হায় সেলুকাস!
যেখানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি স্যানিটেশনের দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটার চেষ্টা করছেন সেখানে ঢাকার কয়েকজন বাড়ীওয়ালা এই দুর্যোগ মুহুর্তে বাড়ী ভাড়া না নেয়ার ঘোষনা দিয়েছেন। কেউ আবার বলেছেন প্রয়োজনে বাড়ী ভাড়া আমাকে না দিয়ে ভাইরাস আক্রান্ত ফ্যামিলিকে সহায়তা করুন। একেই বলে মহানূভবতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০টির বেশি সংস্থা করোনা ভাইরাসের ভেকসিন তৈরীতে ব্যস্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ৪ জনের দেহে এই ভেকসিন প্রয়োগ করেছে। আশা করা যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই এর ফলাফল পাওয়া যাবে।
এই করোনা ভাইরাস মানুষ এবং যন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। মানুষ তার স্বাভাবিক কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারছে না। নিজের বাড়ী বা অন্যত্র কোয়ারেন্টিনে আছেন, আর যন্ত্র নিশ্চল নিথর হয়ে বসে আছে। পৃথিবীর কর্মযজ্ঞ থেমে গেছে। থেমে গেছে অর্থনীতির চাকা। বিশ্ব অর্থনীতি আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছে তা আবার ঘুরে আসবে কত বছর পর তা কেউ বলতে পারবে না। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের কি অবস্থা হবে তা চিন্তা করা দুষ্কর। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের রাষ্ট্র নায়কদের উত্তরনের চিন্তা এখন থেকেই করতে হবে নতুবা অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে। দেশের মানুষ আরো দরিদ্রতম হবে।
আমরা যারা নন-লাইফ বীমা শিল্পে কর্মরত আছি তাদের জন্য বড় দু:সংবাদ হলো আমদানী রপ্তানী প্রায় বন্ধ। ব্যাংক তাদের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কাজের গতি বদলিয়েছে। কোন কোন ব্যাংক বাড়ী থেকেই কাজ করতে বলেছে। আবার কোন কোন ব্যাংক শিফটিং এর মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বীমা শিল্পে কর্মরতরা ঝুঁকির মধ্যে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। কাজের জন্য বিভিন্ন কল-কারখানা, অফিস, ব্যাংকে যাতায়াত করতে হয় যা জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ। করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে আমাদেরও হোম কোয়ারেন্টিনে ১৪ দিনের জন্য থাকা দরকার।
আসুন জনসমাগম এরিয়ে চলি, চোখে-মুখে-নাকে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকি। ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধোঁই, বাড়ীতে অতিথিদের আসা বন্ধ করি, সর্দি কাশি, শ্বাসকষ্ট হলে মাস্ক পড়ি।
আসুন সকলে মিলে ক্ষুধামুক্ত, দরিদ্রমুক্ত, করোনামুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে আল্লাহ-তায়ালার কাছে সহযোগীতা চাই ও একে অন্যের জন্য দোয়া করি, বিশ্ব মানবতা এক মেল বন্ধনে আবদ্ধ হই।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ইসলামী কমাশিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।