নন-লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার খুবই জরুরি

মানসুর আলম সিকদার: কতিপয় নন-লাইফ বীমা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ অনৈতিক কমিশন বাণিজ্য চলছে বলে সূত্র মতে জানা গেছে। অবশ্য এ কথাও সত্যি যে, ভালো কোম্পানিগুলো অথবা অনেক বীমা উন্নয়ন কর্মকর্তাগণ ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ অনৈতিক কমিশন দিয়ে ব্যবসা করে না।

নন-লাইফ বীমা কোম্পানি সাধারণ বীমা করপোরেশনে পুনর্বীমা করলে কমিশন পায় ২০ শতাংশ। অপরদিকে পার্টিকে যদি দেয় ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ কমিশন। যদি তাই হয় তবে সে ক্ষেত্রে নন লাইফ-বীমা কোম্পানির লোকসান হবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।

আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, নন- লাইফ বীমা কোম্পানি ব্যবসা করে কিন্তু লোকসান করবে না। তাই তারা বাধ্য হয়ে আপনার বীমাটি পুনর্বীমা করবে না। অর্থাৎ আপনার প্রতিষ্ঠানটি সুরক্ষিত অথবা ঝুঁকিমুক্ত থাকল না।

মুখে যতই বলুক যে, আপনার প্রতিষ্ঠানটি সুরক্ষিত থাকবে বাস্তবে থাকার কোন সুযোগ নাই। এ জন্য দায়ী অনৈতিক উচ্চ কমিশন।

এ ধরনের অনৈতিক কমিশন কিভাবে বন্ধ করতে হয় তা একজন বীমার বিজ্ঞ-আন্ডাররাইটার খুবই ভালো জানেন। তাই এজেন্ট কমিশন এবং অনৈতিক কমিশন বাণিজ্য সম্পুর্নরুপে বন্ধ এবং সকল বীমা প্রতিষ্ঠানের আইনি সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি বীমা পরিকল্প বাতিল ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত:

২০/১২/২০২০ ইং তারিখে এ সংক্রান্ত সার্কুলার নং- নন-লাইফ ৮২/২০২০ জারি করা হয়েছে এবং মটরের তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি (মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি) বীমা পরিকল্প বাতিল করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

পৃথিবীতে এমন একটি উন্নত রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়া যাবেনা যে, মটর বীমা বাধ্যতামূলক না।

তাই অনেকেই মনে করছেন মটর থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প (মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স) বাতিল করা ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত বরং এটা সংস্কার করা উচিৎ ছিল।

চলমান প্রেক্ষাপট বিবেচনাপূর্বক মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স সংস্কার করা উচিত:

মটর সড়ক অ্যাক্ট ১৯৮৩ (অর্থাৎ ৪১ বছর পূর্বে) করা হয়েছিল, প্রজ্ঞাপণ আকারে জারী হয়েছিল ২০০১ সালে (অর্থাৎ ২৩ বছর পূর্বে) ক) মত্যু: ২০ হাজার টাকা খ) গুরুতর আঘাত: ১০ হাজার টাকা গ) যে কোন আঘাত: ৫ হজার টাকা ঘ) সম্পত্তির ক্ষতি: ৫০ হাজার টাকা। যা বর্তমান বাজারে একেবারেই বেমানান।

যা করা উচিত তা হচ্ছে ক) মৃত্যু জনিত কারণে ২০ হাজার টাকার পরিবর্তে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা খ) গুরুতর আঘাত: ১০ হাজার টাকার পরিবর্তে ১ লাখ টাকা, গ) যে কোন আঘাত: ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৫০ হাজার টাকা, গ) সম্পত্তির ক্ষতি: ৫০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ লাখ টাকা হওয়া উচিৎ বলে অনেকেই মত প্রকাশ করছেন।

মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সটির সংস্কার কি ভাবে হতে পারে?

সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি (আইডিআরএ) থেকে একটি সার্কুলার জারি হয়েছিল সার্কুলার নাম্বার এমআইএসসি ৮০/২০০৮ উক্ত ক্ষতিপূরণের বীমা বর্তমান ট্যারিফ মোতাবেক অতিরিক্ত হারে প্রিমিয়াম আদায় সাপেক্ষে ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ টাকা  ২ হাজার থেকে (২০,০০০ * ৯)= ১ লাখ ৮০ হাজার অর্থাৎ  (১,৮০,০০০ + ২০,০০০) = ২ লাখ পর্যন্ত বর্ধিত করা যেতে পারে এবং (সম্পত্তির ক্ষেত্রে, সর্বোচ্চ টাকা ৫ হাজার থেকে (৫০,০০০ * ৯) ৪ লাখ ৫০ হাজার অর্থাৎ (৪,৫০,০০০ + ৫০,০০০) = ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

এই প্রকল্পটি সংস্কার করা খুব বেশী কঠিন কাজ নয়। যেহেতু মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সটির উপর একটি সার্কুলার জারি হয়েছিল তাই প্রকল্পটির পরিবর্তন করা যথেষ্ট সহজ সাধ্য ব্যপার হয়ে গেল। উপরোক্ত সার্কুলারের উপর ভিত্তি করেও মটর অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্সটি বিজ্ঞ আন্ডাররাইটারদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সংস্কার করা যেতে পারে।

স্ট্যাম্প অ্যাক্ট ১৮৯৯ (১১ এর ১৮৯৯) এবং অ্যামেন্ডমেন্ট অর্থবিল ২৯ শে জুন ২০০০ এবং ৩০ জুন ২০১২ এবং অতিরিক্ত গেজেট ৩০ জুলাই, ২০২২  অনুযায়ী বীমা স্ট্যাম্প ব্যবহারের নিয়মাবলীটিতে পার্থক্য গুলো দেখুন:

ক) মেরিন ইন্স্যুরেন্স (সেকশন-৭)

১) বীমা অংক ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ (বিশ) টাকা হবে।

২)  ১ লাখ টাকার উপরে হলে অবশিষ্ট বীমা অংকের পরবর্তি প্রতি ১ (এক) লাখে ১০ (দশ) টাকা।

পূর্বে ছিল: বীমাকৃত অংকের প্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকায় ১ টাকা।

খ) অগ্নি বীমা

১) বীমা অংক ১ লাখ টাকা পর্যন্ত হলে ষ্ট্যাম্প ২০০ টাকা।

২) অন্য সকল ক্ষেত্রে বীমা অংক যাহাই হোক ষ্ট্যাম্প প্রতিটি বীমা পলিসির জন্য ৫০০ টাকা।

পূর্বে ছিল: যত টাকার মূল্যমানের বিষয়বস্তু হোকনা কেন প্রতিটি পলিসির জন্য ৫০ হারে ষ্ট্যাম্প ধার্য করা হয়েছিল।

গ) এক্সিডেন্টাল এন্ড সিকম্যান ইন্স্যুরেন্স

১) প্রথম বীমা অংক ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ২০ টাকার ষ্ট্যাম্প হবে।

২) ২৫ হাজার টাকার অধিক হলে পরবর্তী প্রতি ৫ হাজার টাকায় ২০ টাকার ষ্ট্যাম্প হবে।

৩) ড.ঈ. এর ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার টাকায় প্রিমিয়ামের উপর ৩০ টাকা অথবা প্রিমিয়ামের উপর ৩ শতাংশ হারে ধার্য করতে হবে।

পূর্বে ছিল: ড.ঈ. এর ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের উপর ২ শতাংশ হারে ধার্য করা হয়েছিল।

উপরোক্ত ষ্ট্যাম্পের বর্ণনামতে আমরা এই মর্মে সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারি যে, মেরিন ইন্স্যুরেন্স, অগ্নি বীমা, এক্সিডেন্টাল এন্ড সিকম্যান ইন্স্যুরেন্স ড.ঈ. ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে বীমা অংক যাহাই হোক ষ্ট্যাম্প প্রতিটি বীমা পলিসির জন্য ৫০০টাকা ব্যবহার করতে হবে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

যারা বীমা বিষয়ে অভিজ্ঞ না তাদেরকে বীমার ব্যপারে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত না: স্ট্যাম্প অ্যাক্ট ১৮৯৯ (১১ এর ১৮৯৯) এবং অ্যামেন্ডমেন্ট অর্থবিল ২৯ শে জুন ২০০০ এবং ৩০ জুন ২০১২ এবং অতিরিক্ত গেজেট ৩০ জুলাই, ২০২২ অনুযায়ী বীমা স্ট্যাম্প ব্যবহারের নিয়মাবলীটি ছিল বীমা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য কালো অধ্যায়।

এই গেজেটের কারণে বীমা ব্যবসা, শুল্ক, ষ্ট্যাম্পের হার সব কিছুই বিরুপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। উদাহরন স্বরুপ:

১) সর্বজনিন সু-রক্ষা নামে একটি বীমা প্রকল্প আছে যার প্রিমিয়াম ছিল ১০০ টাকা এবং ষ্ট্যাম্প ছিল ১০ টাকা, এখন ১০ টাকার পরিবর্তে ষ্ট্যাম্পের মূল্য ৫০০ টাকা যা ৪৯০ টাকাই বেশী। অর্থাৎ প্রিমিয়াম ১০০ + ষ্ট্যাম্প ৫০০ টাকা এবং ভ্যাট ১৫ শতাংশ সর্বোমোট ৬১৫ টাকা দিয়ে (বঙ্গবন্ধু) সর্বজনিন সুরক্ষাবীমা প্রকল্প তেমন কেউই গ্রহন করছে না।

ঠিক একইভাবে অগ্নি বীমায় প্রিমিয়াম হিসাবে ৩০০ টাকা ষ্ট্যাম্প ৫০০ টাকা, পার্সোনাল অ্যাক্সিডেন্ট এ প্রিমিয়াম ৩০০ টাকা, ষ্ট্যাম্পের মূল্য  ৮০০ টাকা।

এভাবে অনেক উদাহরন দেয়া যাবে। পৃথিবীর কোথাও কেউ এ ধরনের নজীর দেখাতে পারবে না যে, প্রিমিয়ামের থেকে ষ্ট্যাম্পের মূল্য বেশী হয় কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের নজির কেন স্থাপন করা হল, ভুলেরও একটা মাত্রা থাকে, এটা কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হল?

অর্থাৎ বীমার ব্যপারে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে অবশ্যই বিজ্ঞ-আন্ডাররাইটারদের সাথে পরামর্শ পূর্বক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত তানা হলে ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। অতএব বীমা স্ট্যাম্প ব্যবহারের নিয়মাবলীটি অবশ্যই সংস্কার করতেই হবে তানা হলে সমগ্র নন-লাইফ বীমা সেক্টরগুলো চরম ক্ষতির সম্মূখীন হবে।