আইন প্রয়োগে দৃঢ়তা দেখাতে না পারলে বীমা খাত ঝুঁকিতে

রাজ কিরণ দাস: বাংলাদেশের বীমা খাত বর্তমানে এমন এক সংকটে পড়েছে, যেখানে আস্থা ও স্বচ্ছতা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। এই খাতের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে বীমা জালিয়াতি- এটি অদৃশ্য কিন্তু মারাত্মক সমস্যা, যা পুরো ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। জালিয়াতি রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, কোম্পানি ও জনগণের যৌথ উদ্যোগ এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।

বীমা খাতের মূলভিত্তি হলো আস্থা। গ্রাহক প্রিমিয়াম প্রদান করেন নিরাপত্তার আশায়, আর কোম্পানি দায়বদ্ধ থাকে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে। কিন্তু যখন জালিয়াতি ঘটে, তখন এই পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙে যায়। একদিকে প্রকৃত দাবিদার ভোগান্তিতে পড়েন, অন্যদিকে সৎ গ্রাহকদের ওপর প্রিমিয়ামের চাপ বাড়ে। এই অবস্থায় প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো সচেতনতা ও সুশাসন।

জনগণের মধ্যে বীমা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকায় অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। বীমার শর্ত, দাবি প্রক্রিয়া ও সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানানো দরকার। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানির নিজস্ব প্রচারণার মাধ্যমে একটি ধারাবাহিক সচেতনতা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মানুষ বুঝতে পারলে, বীমা কেবল কাগজের চুক্তি নয়, বরং এটি আর্থিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

কেবল গ্রাহক নয়, বীমা খাতের কর্মীদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে যেন তারা প্রতারণার ইঙ্গিত বা অসঙ্গতি শনাক্ত করতে পারেন। অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি-ভিত্তিক বিশ্লেষণ একত্রে ব্যবহার করে সন্দেহজনক দাবি চিহ্নিত করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা অ্যানালিটিক্স এখন জালিয়াতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নথি ও লেনদেনকে নিরাপদ ও স্বচ্ছ রাখা সম্ভব, যা জাল তথ্য বা নকল কাগজপত্রের সুযোগ কমিয়ে দেয়।

আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি। জালিয়াতি প্রতিরোধে আইন থাকতে হবে কঠোর, বাস্তবায়ন হতে হবে নিরপেক্ষ ও কার্যকর। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিশেষ করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাজ শুধু অনুমোদন দেয়া নয়, বরং খাতের সার্বিক শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তদন্ত, তদারকি ও শাস্তি কার্যকর না হলে প্রতারণার সংস্কৃতি আরও গভীরে প্রোথিত হবে।

বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও তথ্য বিনিময় বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে যৌথ তদন্ত ও তথ্য ভাগাভাগির ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে জালিয়াতির প্যাটার্ন চিহ্নিত করা সহজ হবে এবং প্রতারকরা বারবার ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একই কৌশল প্রয়োগ করতে পারবে না।

সাধারণ জনগণকেও এ বিষয়ে হতে হবে সতর্ক। প্রতারণার সন্দেহ দেখা দিলে যেন যে কেউ সহজে অভিযোগ জানাতে পারেন, সেজন্য গোপনীয় ও নিরাপদ অভিযোগ ব্যবস্থা থাকা উচিত। অনেক সময় মানুষ ভয়ে বা ঝামেলার আশঙ্কায় অভিযোগ করতে চায় না। এই মানসিকতা ভাঙতে হবে, কারণ প্রতারণা রোধে প্রত্যেক নাগরিকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।