সংকট ব্যবস্থাপনা বীমার গুরুত্ব বাড়ছে কেন

রাজ কিরণ দাস: আধুনিক ব্যবসা এখন আর শুধু পণ্য, সেবা আর বিক্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন লেনদেন, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অসংখ্য অদৃশ্য ঝুঁকি। একদিকে সাইবার হামলা ও তথ্য চুরি, অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা, গ্রাহকের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন বা হঠাৎ পণ্য প্রত্যাহারের চাপ- এসব ঘটনাই মুহূর্তের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের সুনাম, আস্থা এবং আয়কে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। এমন বাস্তবতায় সংকট ব্যবস্থাপনা বীমা আর অতিরিক্ত সুবিধা নয়, বরং ব্যবসার টিকে থাকার অন্যতম নিরাপত্তা বলয় হয়ে উঠছে।

সংকট ব্যবস্থাপনা বীমা মূলত সেই সব পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তৈরি, যখন কোনো বড় ধরনের অঘটন ইতোমধ্যেই ঘটেছে এবং প্রতিষ্ঠান দ্রুত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এই বীমা সাধারণত এক বা একাধিক বিশেষায়িত পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বীমা কোম্পানিকে যুক্ত করে। কোনো ঘটনা ঘটলে প্রতিষ্ঠান সরাসরি সেই সংকট বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে পারে।

এই বিশেষজ্ঞরা প্রথমেই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন, কোন ধরনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, কোন দিক থেকে সুনামের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি এবং কীভাবে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে, সেই রূপরেখা তৈরি করেন। এরপর কর্মীদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, গ্রাহকদের কী আশ্বাস দিতে হবে, সরবরাহকারী এবং অংশীদারদের সামনে কী বার্তা যাবে, এমন সংবেদনশীল যোগাযোগ পরিকল্পনা সাজিয়ে দেন। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী বলা উচিত, কী বলা উচিত নয় এবং কীভাবে সংবেদনশীল তথ্য সামলাতে হবে, তারও কৌশল গড়ে তোলেন।

কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, সংকট শেষে তারা প্রায়ই একটি পর্যালোচনা করেন। কোন জায়গায় ভুল হয়েছে, কোথায় প্রস্তুতি কম ছিল, ভবিষ্যতে একই ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে জন্য কী ধরনের নতুন ব্যবস্থা নেয়া দরকার- এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট সুপারিশ দেন। ফলে একটি প্রতিষ্ঠান কেবল একটি সংকট থেকে বেরিয়ে আসে না, বরং আরও শক্তিশালী ও সচেতন হয়ে ওঠে।

একটি গুরুতর ঘটনার পর শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতি হয় না; মানসিক আঘাতও সমান ভয়াবহ। হ্যাকিংয়ের পর কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার পর অনেকেই কাজের জায়গাকে আর নিরাপদ মনে করেন না, আবার বড় রকমের কোন ভুল কিংবা দুর্ঘটনার পর গ্রাহকের আস্থা ফিরে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। সংকট ব্যবস্থাপনা বীমা অনেক ক্ষেত্রেই এসব মানসিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক চাপ সামলাতে সাহায্য করে।

বীমা থেকে পাওয়া সহায়তায় কর্মী ও গ্রাহকদের জন্য পেশাদার মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুর্বলতা থাকলে অতিরিক্ত সিকিউরিটি, নজরদারি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তা দ্রুত শক্তিশালী করা যায়। সংবেদনশীল বা জটিল পরিস্থিতিতে জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ, সঙ্কট যোগাযোগ পরামর্শক বা এমনকি অপহরণ-দর কষাকষি বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। ব্যবসা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে বা সীমিত পরিসরে চালাতে বাধ্য হলে যে আয় ক্ষতি হয়, তা সামাল দিতেও এই বীমা ভূমিকা রাখে।

এভাবে সংকট ব্যবস্থাপনা বীমা প্রতিষ্ঠানকে কেবল ক্ষতি থেকে উত্তরণের অর্থনৈতিক সহায়তাই দেয় না, বরং দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের ভেতরের আস্থা, স্থিতিশীলতা এবং সাংগঠনিক সক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

সব ইতিবাচক দিক থাকার পরও সংকট ব্যবস্থাপনা বীমা নিখুঁত সমাধান নয়। অনেক পলিসি নির্দিষ্ট ধরনের ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু কাভার করে না। কোথাও আবার স্বতন্ত্রভাবে বীমা কিনতে গেলে জটিলতা দেখা দেয়, কারণ বেশিরভাগ কোম্পানি এটিকে অন্য বড় ঝুঁকিভিত্তিক বীমার অংশ হিসেবে বিক্রি করে। বিভিন্ন কভারেজের জন্য নির্দিষ্ট সীমা থাকায় কোনো বড় ধরনের ব্যাপক ক্ষতির ক্ষেত্রে সব ব্যয় মেটানো সম্ভব নাও হতে পারে। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথমে প্রতিষ্ঠানকেই খরচ বহন করতে হয়; পরে বীমা কোম্পানি বিল যাচাই করে অর্থ ফেরত দেয়।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা হলো, এই বীমা সাধারণত ঘটনার পরের ধাপ নিয়ে কাজ করে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যেমন সিকিউরিটি অডিট, নিয়মিত ড্রিল বা ঝুঁকি বিশ্লেষণ অনেক সময়ই এর আওতার বাইরে পড়ে যায়। ফলে শুধু বীমা কিনলেই সব ঝুঁকি শেষ- এমন ভুল ধারণা ব্যবসার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।

তবু বাস্তবতা হলো, ঝুঁকিমুক্ত ব্যবসা বলে আর কিছু নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও, কোনো অসন্তুষ্ট গ্রাহকের অভিযোগ, কিংবা একটি তথ্য ফাঁস- এসবই রাতারাতি প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতে পারে। আইনগত ঝামেলা, গ্রাহক হারানো এবং অংশীদারদের আস্থা সংকটে পড়ে যখন সব মিলিয়ে চাপ তৈরি হয়, তখন একটি পেশাদার সংকট ব্যবস্থাপনা কাঠামোর অভাব খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এই অভাব পূরণেই সংকট ব্যবস্থাপনা বীমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।