ব্যবস্থাপনা ব্যয় সংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধনের দাবি ফারজানা চৌধুরীর
১০১ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ব্যাখ্যা দিলেন গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা চৌধুরী। অতিরিক্ত ব্যয়ের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে ১৯৫৮ সালের বীমা বিধি দ্রুততম সময়ে সংশোধনের দাবি জানালেন তিনি। সোমবার ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে তিনি এসব কথা জানান। তার পুরো লিখিত বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলো-
‘বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অতিরিক্ত খরচের বিষয়ে গ্রীন ডেল্টার মূখ্য নির্বাহী ফারজানা চৌধুরী বলেন, এটা সত্যি যে, ১৯৫৮ সালের বীমা বিধিতে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে ব্যয় এখন বেড়ে গেছে। এমনকি আমাদের নিজেদের খরচও উল্লেখিত বরাদ্দ পরিমাণের চেয়ে বেশি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এটাও বিবেচনা করা উচিত যে, ৫৮ বছর আগের নির্দেশনা এখন কতটা যুক্তিসঙ্গত। কারণ, সময়ের সাথে সাথে অনেক পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে এখন সময় এসেছে ১৯৫৮ সালের বীমা বিধি সংশোধন করা। যাতে বীমা কোম্পানিগুলো আরো ভালোভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
দেশের বীমা শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে ফারজানা চৌধুরী বলেন, খাতটি এখনো তুলনামূলকভাবে অপরিণত। আমাদের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম বীমার আওতায় এসেছে। জিডিপি’তে বীমা শিল্পের অবদান ১ শতাংশের কম। এর মানে হচ্ছে, বীমা খাত বৃদ্ধির সম্ভাবনা অপরিসীম। গত এক দশক ধরে এই শিল্পের পরিধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ বীমার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন এবং বিভিন্ন বীমা পলিসি থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে তারা অবগত।
ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালের চেয়ে বর্তমানের বাজার পরিস্থিতি আমূল পরিবর্তন হয়েছে, যা এই ব্যয়ের অন্যতম কারণ। এছাড়া ’৫৮ সালের সাথে এখনকার তুলনা করলে মুদ্রস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যাতায়াত, বিজ্ঞাপন, কর্মচারিদের বেতন-ভাতা ইত্যাদির খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ স্ফীতির পরিমাণ ৩০০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি ২০০৫ সালে বীমা রেজিস্ট্রেশন ফি নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা ১৩৩ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
১৯৯১ সালে সরকার প্রায় সব খরচের উপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আরোপ করেছে। এর ফলে এটি আমাদের ব্যয়ের খাতে যুক্ত হয়েছে। এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৫৮ সালে যখন বীমা বিধি জারি করা হয়, তখন এতে মূসক’র কোন বিধান ছিল না। আমাদের যদি ভ্যাট দিতে না হতো তাহলে নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকতে সক্ষম হতাম।
যদিও খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু সেন্ট্রাল রেটিং কমিটি (সিআরসি) বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রিমিয়াম হার হ্রাস করেছে। এই হ্রাসকৃত প্রিমিয়াম বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য বোঝা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বাজারে এখন ৪৫টি সাধারণ বীমা কোম্পানি আছে। যেহেতু আমাদের বীমা শিল্পের আকার তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট তাই কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা অনেক তীব্র। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কোম্পানিগুলোকে দক্ষ জনবল আকর্ষণ, নিয়োগ এবং ধরে রাখার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়।
তিনি আরো বলেন, আমরা গ্রীন ডেল্টায় সবসময় দক্ষ বীমা পেশাদার গড়ার ওপর জোর দিয়ে থাকি। এই কারণে আমরা প্রায়শই আমাদের কর্মচারিদের দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে পাঠিয়ে থাকি। এতে যদিও আমাদের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে আমরা যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ পেশাদার জনবল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এছাড়া বীমা শিল্প সম্মিলীতভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ কারণেও বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে গেছে।
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের যৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে গ্রীন ডেল্টার এই সিইও বলেন, এটা বলা হয়ে থাকে যে, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় একটি কোম্পানির ক্লায়েন্টদের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ ও বীমা দাবি পরিশোধ করার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স জন্মলগ্ন থেকেই এর শেয়ারহোল্ডারদের উল্লেখযোগ্য হারে লভ্যাংশ দিতে সক্ষম হয়েছে। গত ২০ বছরে আমরা গড়ে ৩৭ শতাংশ দিয়েছি। যা বীমা শিল্পে আগে কখনো দেখা যায়নি। এটি আমাদের দক্ষ ব্যবস্থাপনার একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। আমরা এই প্রবণতা আগামী দিনেও অব্যাহত রাখার আশা রাখছি।
গ্রীন ডেল্টা সবসময় তার দ্রুত দাবি নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। আমাদের ক্লায়েন্টরা আমাদের দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট এবং আমারা এ কারণে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশংসিত হয়েছি। আমরা বাংলাদেশের বীমা খাতের কিছু বৃহত্তম দাবি সাফল্যের সাথে নিষ্পত্তি করতে পেরেছি। শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ পরিশোধ, আমাদের মূল্যবান গ্রাহকদের দাবি প্রতিস্থাপন এবং সরকারের সমস্ত প্রাসঙ্গিক ট্যাক্স পরিশোধ সত্ত্বেও আমাদের মোট সম্পদ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আমাদের কোম্পানির আর্থিক স্থিতিশীলতার নিদর্শক।
আমরা বিভিন্ন আর্থিক সূচকের নিরিখে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছি। আমাদের ‘অ্যাভেইলেভল সলভেন্সি মার্জিন’ প্রয়োজনীয় ‘রিকয়ার্ড সলভেন্সি মার্জিন’র তুলনায় অনেক বেশি। এটি আমাদের গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধের ক্ষমতা প্রমাণ করে। গ্রীন ডেল্টা দেশের সব বীমা কোম্পানির মধ্যে ক্রেডিট রেটিংয়ে শীর্ষে রয়েছে। বাংলাদেশে আমরাই একমাত্র বীমা কোম্পানি যা পরপর দুই বছর ‘এএএ’ ক্রেডিট রেটিং অর্জন করেছে। আমরা দেশের স্বনামধন্য অডিট ফার্ম দ্বারা আমাদের বার্ষিক অডিট করিয়ে থাকি।
এসব বিষয়ের আলোকে এটাই প্রতীয়মান যে, আমাদের খরচ ১৯৫৮ সালের বীমা বিধির চেয়ে যদিও বেশি, কিন্তু আমরা আমাদের সমস্ত মূল্যবান অংশীদারদের অঙ্গীকার বা দায়ভার পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। এটি আমাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং সুশাসনের বিষয়টি প্রতীয়মান করে।
বীমা বিধি পরিবর্তনে আইডিআরএ’র করণীয় কি হতে পারে এ বিষয়ে ফারজানা চৌধুরী বলেন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে বীমা শিল্পে স্বচ্ছলতা আনতে রিলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বীমা কোম্পানিগুলো যাতে সাফল্যের সঙ্গে ব্যাবসা পরিচালনা করতে পারে সে চেষ্টা তারা করে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, এখন উপযুক্ত সময় এসেছে ১৯৫৮ সালের বীমা বিধি নিয়ে আইডিআরএ’র কিছু করার।
এরইমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে যে, গত ৫৮ বছরে সব প্রাসঙ্গিক বিষয় এতো বদলে গেছে, ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সেই নির্ধারিত পরিমাণ এখন অনেকটাই অযৌক্তিক। উপরন্তু, বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় ব্যাংকগুলোর থেকে তুলনামূলক অনেক কম।
তাছাড়া বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সিলিং নিজ নিজ কোম্পানির সলভেন্সি মার্জিনের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা উচিত। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি একটি নেতৃত্বস্থানীয় কোম্পানি আর অপেক্ষাকৃত একটি ছোট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সিলিং এক হতে পারে না। এ অবস্থায় আমরা সমগ্র শিল্পের পক্ষ থেকে আইডিআরএ’কে আন্তরিকভাবে অনুরোধ করছি উপরোক্ত বিষয় বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার জন্য। এতে বীমা খাত অনেক উপকৃত হবে এবং এই শিল্পের সুনাম বাড়বে।’
প্রকাশের তারিখ- ২৬ জুলাই, ২০১৬