অযোগ্য কামরুলকে নিয়োগ দিতে যমুনা লাইফের আবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইন অনুসারে কামরুল হাসান খোন্দকার মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাওয়ার অযোগ্য। অথচ অদৃশ্য কারণে এই কামরুল হাসানকেই মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনুমোদন দিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে যমুনা লাইফ। কোম্পানিটির ৩৫তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ২ ডিসেম্বর এ আবেদন করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনুমোদন লাভের জন্য কামরুল হাসান খোন্দকারের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতা কোনটিই নেই। বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা ২০১২ অনুসারে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করলে ওই ব্যক্তি মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ লাভের অযোগ্য।

মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২ এর ৩(ক)’র বিধান অনুসারে, কোন ব্যক্তির কোন বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগলাভের জন্য কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে অন্যূন ৩ বছর মেয়াদী স্নাতক ও এক বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বা ৪ বছর মেয়াদী স্নাতক ও সমমানের ডিগ্রি থাকতে হবে।

কামরুল হাসান খোন্দকারের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুসারে তিনি ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে দু’বছর মেয়াদী ব্যাচেলর অব কমার্স (বিকম) পাস করেন। পরে ২০০২ সালে ভারতের ডিমড ইউনিভার্সিটি অব লক্ষ্মৌ থেকে ১ বছর মেয়াদী এক্সিকিউটিভ এমবিএ করেন। তবে বিদেশি এই ডিগ্রির মান ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত নয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন।

এর আগে ১৯৮৪ সালে হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করেন কামরুল হাসান এবং নোয়াখালীর হরিনারায়ণপুর হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেন ১৯৮২ সালে। আর বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি থেকে এবিআইএ (পার্ট-১) সম্পন্ন করেছেন ২০০১ সালের নভেম্বরে।

শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতাই নয় আইন অনুসারে কর্ম অভিজ্ঞতাতেও অযোগ্য কামরুল। বীমা মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা, ২০১২ এর ৩(খ)’র বিধান অনুসারে, ইতোপূর্বে কোন বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বা উহার অব্যবহিত নিম্নপদে অন্যূন ৩ বছর কর্ম অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথচ কর্ম অভিজ্ঞতার সনদগুলোর তথ্য অনুসারে কামরুলে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদে ৩ বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা নেই।

সনদগুলোর তথ্য অনুসারে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স যোগদানের আগে কামরুল হাসান সানফ্লাওয়ার লাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ ও গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। এসব কোম্পানিতে চাকরির নিয়োগ ও অব্যহতিপত্রের তথ্য অনুসারে, মূখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্ন পদে কামরুল হাসানের কর্ম অভিজ্ঞতা রয়েছে ৯ মাস ২২ দিন। এ অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেন গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সে চাকরির সময়ে।

আর যমুনা লাইফে চাকরিকালীন কামরুল হাসানের মূখ্য নির্বাহী পদে অভিজ্ঞতা ৭ মাস ২৫ দিন। যদি অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডি.এমডি) পদ শূন্য থাকায় চীফ মার্কেটিং অফিসার পদকে মূখ্য নির্বাহীর অব্যাবহিত পরের পদ ধরা হয়। এই হিসেবে মূখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্ন পদে কামরুল হাসানের সর্বসাকুল্যে কর্মঅভিজ্ঞতা ১ বছর ৫ মাস ১৭ দিন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২ মার্চ যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে যোগদান করেন কামরুল হাসান খোন্দকার। এসময় তাকে কোম্পানিটির চীফ মার্কেটিং অফিসার (সিএমও) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহীর পদ এবং এর অব্যাবহিত পরের পদ তথা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডি.এমডি) পদ শূন্য থাকায় গত ৭ এপ্রিল কামরুল হাসানকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়।

এর আগে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত সানফ্লাওয়ার লাইফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (উন্নয়ন প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন কামরুল হাসান। সানফ্লাওয়ার লাইফের অর্গানোগ্রাম অনুসারে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদটি মূখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ। সেই হিসেবে কামরুল মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদে ছিলেন না। তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে। এ সময় বীমা কোম্পানিটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ ছিল উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) ।

এ ছাড়াও ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ থেকে ২০১৮ সালর ১০ জুলাই পর্যন্ত প্রাইম ইসলামী লাইফের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এসিস.এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কামরুল হাসান খোন্দকার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এসিস.এমডি) পদটি প্রাইম ইসলামী লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদ নয়।

তবে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ৯ মাস ২২ দিন মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদে দায়িত্ব পালন করেছেন কামরুল হাসান। ২০১৬ সালের ১৮ মে থেকে ২০১৭ সালের ১২ মার্চ পর্যন্ত তিনি কোম্পানিটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিযুক্ত ছিলেন। এ সময় তিনি বীমা কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্বও পালন করেছেন।

এই হিসাবে কামরুল হাসানের বীমা পেশায় মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত পরের পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে ৯ মাস ২২ দিন। আর যমুনা লাইফে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডি.এমডি) পদ শূন্য থাকায় চীফ মার্কেটিং অফিসার পদকে মূখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ ধরলেও গত ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার এই অভিজ্ঞতা দাঁড়ায় সর্বমোট ১ বছর ৫ মাস ১৭ দিন (৭ মাস ২৫ দিন + ৯ মাস ২২ দিন) ।

এদিকে কামরুল হাসানের এক্সিকিউটিভ এমবিএ সনদের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)’র রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক জানিয়েছেন, বিদেশি ডিগ্রির ক্ষেত্রে সমতা বিধান না করে সে বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদৌ সেখানে পড়ালেখা করেছেন কিনা সেটা আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া ওই বিদেশি ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য কিনা এবং গ্রহণযোগ্য হলেও সেটার মান কি হবে তা সমতা বিধান না করে বলা সম্ভব নয়।

ইউজিসি’র রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের উপ-পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, বিদেশি অনেক ডিগ্রি এখানে গ্রহণ না হওয়ার নজির আছে। তাই বিধি মোতাবেক সমতা বিধান না করে নিশ্চিত কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে কামরুল হাসান খন্দকারের বিদেশি ডিগ্রির বিষয়ে তিনি বলেন, আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এটি এক বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি। তবে এর মান ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বীমা কোম্পানির শীর্ষ পদ। এই পদে নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার বিষয়ে সুষ্পষ্ট বিধিমালা রয়েছে। সে অনুসারে যোগ্যতা যাচাই বাছাই করে মূখ্য নির্বাহী নিয়োগের পূর্ব অনুমোদন দেয়ার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। তবে শীর্ষ এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক যাচাইয়ের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির।

এসব বিষয়ে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিসি) কামরুল হাসান খোন্দকার বলেন, সরকারের বিধি-বিধান পরিপূর্ণ মেনেই আমার আবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এরপরও যদি কারো কোন অবজার্ভেশন থাকে তবে সে বিষয়ে আমার আলাদা করে কিছু বলার নেই।