বীমা চুক্তির আইনগত দিক
বীমা বিষয়ে একটি পাঠক সমাদৃত বই “যে ব্যবসা সম্মানের যে ব্যবসায় মূলধন লাগে না”। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত বইটি লিখেছেন বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি (বিজিআইসি)’র প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এম এ সামাদ। ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সম্মানসহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে কর্মজীবন শুরু হলেও ১৯৫১ সাল থেকে তিনি বীমাকে সার্বক্ষণিক পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।বাংলাদেশের বাইরে বীমার ওপর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনারে তিনি যোগদান করেন। ইউএনডিপি’র ফেলোশিপ নিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সফর করেছেন এম এ সামাদ। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে এম এ সামাদ’র এই বই থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে হুবহু তুলে ধরা হলো। আজ থাকছে “বীমা চুক্তির আইনগত দিক”।
বীমাপত্র আইনগতভাবে বৈধ একটি চুক্তি; কাজেই চুক্তি আইনের শর্ত অনুযায়ী এ বৈধতা বিচার করে দেখতে হবে। আইনগতভাবে বৈধ প্রত্যেকটি চুক্তির মধ্যে নিম্নলিখিত উপাদান থাকা আবশ্যক:
১। অপ্রত্যাহৃত প্রস্তাব (Unreviked offer)
২। শর্তবিহীন সম্মতি (Unqualified Acceptance)
৩। চুক্তির স্বার্থ বা গঠনপ্রণালী (Consideration or Form)
৪। সম্মতির যথার্থতা (Genuiness of consent)
৫। আইনসম্মত উদ্দেশ্য (Legality of subject)
৬। চুক্তি ক্ষমতা (Capacity to contract)
বীমা চুক্তিতে প্রস্তাব ও সম্মতির নিদর্শন হচ্ছে যথাক্রমে বীমাকারীর দরখাস্ত বা প্রস্তাব পেশ এবং বীমা কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব গ্রহণ করার সম্মতিপত্র। চুক্তির আইনগত বৈধতার জন্য এই প্রস্তাব হবে অপ্রত্যাহৃত এবং সম্মতিপত্র হবে শর্তবিহীন অর্থাৎ একবার যে প্রস্তাব পেশ করা হবে, সে প্রস্তাবের শর্তসমূহ প্রস্তাবকারী প্রত্যাহার করতে পারবেন না এবং পরবর্তী সময়ে চুক্তিপত্র অর্থাৎ বীমা পলিসি ঐ প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই সম্পাদিত হবে। বীমা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পেশকৃত প্রস্তাব বিনা শর্তে গ্রহণ করতে হবে। যদি কোন শর্ত আরোপ করে কিংবা প্রস্তাবপত্র সংশোধনসাপেক্ষে সম্মতিপত্র ইস্যু করা হয়, তাহলে ঐ সম্পতিপত্রকে পাল্টা প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করা হবে এবং প্রস্তাবকারী ঐ সংশোধিত প্রস্তাবপত্রে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর প্রদান না করলে আইনসম্মত কোন চুক্তিপত্র সম্পাদন করা যাবে না। চুক্তি আইনের ধারা অনুযায়ী যে কোন বৈধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারীদের চুক্তি সম্পাদনে স্বার্থ নিহীত আছে বলে প্রমাণ দিতে হবে। জীবন বীমা চুক্তিতে বীমাকারীর স্বার্থ হচ্ছে বীমা সংস্থার দাবি মেটানোর নিশ্চয়তা প্রদান এবং বীমা সংস্থার স্বার্থ হচ্ছে বীমাকারীর প্রিমিয়াম প্রদানের ক্ষমতা। স্বার্থের উপস্থিতি বিদ্যমান থাকার পরও বীমা আইন এবং স্ট্যাম্প আইন মোতাবেক বীমা চুক্তির গঠন প্রণালী নির্ধারিত হবে।
* বৈধ চুক্তির আর একটি উপকরণ হচ্ছে চুক্তি সম্পাদনে উভয় পক্ষের সদিচ্ছার প্রকাশ, অসৎ বা কোনো রকম ক্ষতিকর উদ্দেশ্য নিয়ে কোন পক্ষ চুক্তি সম্পাদন করেছেন- এটা প্রমাণিত হলে চুক্তি অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। বীমা চুক্তিতে বীমাকারীর চরম সদিচ্ছা (utmost good faith) বৈধ চুক্তির একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। বীমাকারীর চরম সদিচ্ছার নিদর্শন হচ্ছে- তিনি প্রস্তাবপত্রে ডাক্তারি পরীক্ষার সময় কিংবা বীমা সংস্থার কাছে যেসব বিবরণ দেবেন তা খোলাখুলি বিবৃত করতে হবে এবং জ্ঞাতসারে তিনি কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রাখতে পারবেন না। পরবর্তী পর্যায়ে যদি কোন দাবি পরিশোধের প্রশ্ন আসে এবং তখন যদি বীমা কর্তৃপক্ষ প্রমাণ করতে পারে যে, বীমাকারী প্রস্তাবপত্র দাখিল করার সময় জ্ঞাতসারে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে কোন প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রেখেছেন, তখন সম্পূর্ণ বীমা চুক্তি বাতিল বলে ঘোষিত হবে এবং বীমারকারীর কোন দাবি পরিশোধ করা হবে না। বিশেষ ক্ষেত্রে শুধু আদায়কৃত প্রিমিয়ামের একটা অংশ ফেরত দেয়া যেতে পারে।
* বীমা চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে- এ চুক্তিতে বীমাযোগ্য স্বার্থের (Insurable Interest) উপস্থিতি, যদি এটা না থাকে তাহলে এ চুক্তি আইনের চোখে অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বাজি খেলার (Wagering) সমতুল্য গণ্য করে অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। নিজের জীবনের ওপর যখন পলিসি গ্রহণ করা হয় তখন তাতে সাধারণত "বাজি খেলার" কোন কারণ থাকতে পারে না এবং এতে বীমাযোগ্য স্বার্থের নিদর্শন থাকারও প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু প্রস্তাবকারী এবং বীমাকারী যদি একই ব্যক্তি না হয়ে একজন অন্যজনের জীবন বীমার প্রস্তাব পেশ করেন তখন সেই প্রস্তাবের মধ্যে অবশ্যই বীমাযোগ্য স্বার্থের নিদর্শন থাকতে হবে। আপনি ইচ্ছে করলেই যে কোন ব্যক্তির জীবনের ওপর বীমা প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারবেন না। আইনের চোখে বৈধ হতে হলে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে বীমাযোগ্য স্বার্থের উপস্থিতি রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়:
(১) নিজের জীবনের ওপর
(২) স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর জীবনের ওপর
(৩) স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর জীবনের ওপর
(৪) ব্যবসায়ের এক অংশীদার কর্তৃক অন্য অংশীদারের জীবনের ওপর (বীমার অঙ্কের সর্বোচ্চ পরিমাণ অংশীদারের আদায়কৃত মূলধনের পরিমাণের চেয়ে বেশি হতে পারবে না)
(৫) মহাজন কর্তৃক খাতকের জীবনের ওপর (বীমার অঙ্কের সর্বোচ্চ পরিমাণ গৃহীত ঋণের চেয়ে বেশি হতে পারবে না)
(৬) জামিনদার কর্তৃক যার জামিন হয়েছে তার জীবনের ওপর (বীমার অঙ্কের পরিমাণ জামিনের মোট অঙ্কের বেশি হতে পারবে না)
(৭) মালিক কর্তৃক কর্মচারীর জীবনের ওপর (বীমার অঙ্কের সর্বোচ্চ পরিমাণ চাকরীর শর্ত অনুযায়ী নোটিশকালের মোট বেতন বা মজুরির বেশি হতে পারবে না)
(৮) কর্মচারী কর্তৃক মালিকের জীবনের ওপর (বীমার অঙ্কের সর্বোচ্চ চাকরীর পরিমাণ শর্ত অনুযায়ী অনাদায়কৃত মোট বেতন কিংবা মজুরিরর বেশি হতে পারবে না)
* চুক্তি সম্পাদন করার একটা বিশেষ ক্ষমতা থাকা চাই, যেমন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি, মাতাল বা বিকৃত মস্তিস্ক এবং শত্রু দেশের নাগরিক যদি বীমা চুক্তি সম্পাদন করেন, তাহলে আইনের চোখে সে চুক্তি বৈধ বলে বিবেচিত হতে না।