ইসলামী বীমার বৈশিষ্ট এবং সাধারণ উপাত্ত সমূহ
"ইসলামী বীমার মৌলিক ধারণা ও কর্মকৌশল" একটি পাঠক সমাদৃত বই। ২০১৫ সালে প্রকাশিত বইটি লিখেছেন ড. আ ই ম নেছার উদ্দিন। তিনি প্রাথমিক মাধ্যমিক মাদ্রাসা ও কলেজ শিক্ষা সমাপ্ত করে সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরআগে মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় তিনি দু'টি বিষয়ে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং ২০০২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ড. নেছার উদ্দিন ছাত্রজীবন থেকেই লেখা-লেখি ও সাহিত্য চর্চার প্রতি ঝুকে পড়েন। তার লেখা বেশ কিছু বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আল্লাহর শাশ্বত আহবান, সিয়াম সাধনা ও ত্যাগের মহিমা, ইসলামের পারিবারিক জীবন, ভারতীয় মুসলমানদের সমস্যা, ইসলামের মতানৈক্য পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। সীরাতে রাহমাতুল্লিল আলামীন নামে একটি গ্রন্থের তিনি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তার আরও বেশ কিছু প্রকাশনা ও গবেষণা কর্ম রয়েছে।
বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি মাসিক ম্যাগাজিন পত্রিকা চিন্তাভবনা'র সম্পাদক ও প্রকাশক। জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক ও সাময়িকীতে তার বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি'র পাঠকদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে ড. আ ই ম নেছার উদ্দিন'র এই বই থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে হুবহু তুলে ধরা হলো। আজ থাকছে “ইসলামী বীমার বৈশিষ্ট এবং সাধারণ উপাত্ত সমূহ”।
ইসলামী মূল্যবোধের আওতায় বীমা ব্যবস্থা কিছু সুনির্দিষ্ট মৌলিক বৈশিষ্টপূর্ণ হয়। এসব মৌলিক বৈশিষ্টগুলোকে প্রধানত ৬টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
১. সততা (ইখলাস)
প্রতিটি লেনদেন এবং চুক্তি আল্লাহ পাকের কাছে থেকে পুরস্কার পাওয়ার আশায় সততা ও পবিত্রতার মাধ্যমে সম্পাদন করতে হবে। আল্লাহ পাক বলেন, "তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে"। (আল কুরআন)
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেন, নিয়তের উপর কর্মফল নির্ভর করে এবং তাই যে ব্যক্তি যে রকম নিয়ত করে সে সেরকম ফল পায়। (বুখারী)
অধিকন্তু, বীমা চুক্তির পক্ষগুলোকে অবশ্যই সততার উপর থাকতে হবে, যাতে লাভ নয় বরং একজনকে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি ও লোকসান থেকে উদ্ধারের জন্য পারস্পারিক সহযোগিতা, সংহতি এবং ভ্রাতৃত্ববোধের মূলনীতির ভিত্তিতে লেনদেন করতে বাধ্য থাকতে হবে।
বীমাকারক ক্ষতি বা লোকসান থেকে বীমা গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দায়িত্বগ্রহণ করে যদিও সে (বীমাকারক) চূড়ান্ত নিরাপত্তা দেয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কারণ আল্লাহ-ই একমাত্র সত্তা যিনি সমগ্র বিশ্বে নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষমতার অধিকারী। তিনি বলেন, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব তারই।তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান- তিনি সব কিছু করতে সক্ষম। (আল কুরআন)
২. শরীয়াহ'র নীতিমালা
ইসলামী বিধান অনুযায়ী কোন বীমা ব্যবসা বৈধ হবে না, যদি তার কেন কাজ শরীয়তের কোন নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হয়। তাই কেন বীমা চুক্তির বৈধতার পূর্ব শর্ত হবে, তার কোন বিষয়ই শরীয়তের কোন ধারার সাথে সাংঘর্ষিক হবে না। আল্লাহ পাক বলেন, "যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কষ্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।" (আল ইমরান)
৩. নৈতিক গুণাবলী
কোন বীমা চুক্তি ও ব্যবস্থায় অবশ্য নৈতিক দায়-দায়িত্ব থাকবে। এ ধরণের নৈতিক দায়ি-দায়িত্ব ও মূলবোধ নিম্নেবর্ণিত হয়েছে:
ক. ইসলামী বীমা চুক্তি অনুযায়ী পক্ষগুলো সর্বাত্মকভাবে আন্তরিক বিশ্বাস, সততা, অকপটতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার নীতিমালার অনুসরণ করবে। পবিত্র কোরআনে এই বিষয়টি উল্লেখ আছে: "তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না"। (আল ইমরান)
খ. বীমা চুক্তির সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কিছু পাওয়ার জন্য লোভী না হয়ে বরং অপ্রত্যাশিত কোন দুর্যোগ বা ক্ষতি থেকে কাউকে রক্ষার লক্ষ্যে পারস্পারিক সহযোগিতার নীতির ভিত্তিতে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে।
৪. সুবিধা, স্বার্থ ও উপাদান সমূহ
লেনদেনে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো থাকতে হবে। যেমন-
ক. চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর আইনগত সামর্থ্য;
খ. বীমাকরণ ব্যবস্থার আইনগত গ্রহণযোগ্যতা;
গ. ক্ষতিপূরণ ধারা: চুক্তিবদ্ধ ক্ষেত্রে ক্ষতির জন্য বীমা গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দিতে বীমাকারীকে অবশ্যই বাধ্য থাকবে;
ঘ. চুক্তি অনুযায়ী বীমা গ্রাহককে প্রিমিয়ামের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে;
ঙ. উভয়পক্ষের পারস্পারিক সম্মতি উপস্থিতি থাকতে হবে;
চ. প্রস্তাব ও গ্রহণযোগ্যতা বীমাকারক ও বীমা গ্রহীতার আনুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করবেন;
ছ. চুক্তিবদ্ধ পলিসির মেয়াদের সময়সীমার কথাও চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে।
৫. অনুসরণীয় নীতি
সুদ (রিবা) ভিত্তিক নীতিমালায় পরিচালিত হবে না বরং তা হবে আল-মুদারাবা আর্থিক পদ্ধতি অনুসারে, যেখানে উভয় পক্ষ দেয় প্রিমিয়াম ও কোম্পানির পলিসির লাভ ও ডিভিডেন্ট ভাগ করে নেয়।
৬. জ্ঞান ও বিবেকসিদ্ধ উপাদান
ইসলামী জীবন বীমা পলিসি বস্তুগত লাভের কোন ইঙ্গিতবাহী নয় কিংবা কারো জীবন, মৃত্যু অথবা ভাগ্যের ব্যাপারে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা বুঝায় না। বরং এর লক্ষ্য হলো অপ্রত্যাশিত ক্ষতি, লোকসান কিংবা দুর্দশার বিপরীতে বস্তুগত সাহায্য প্রদানের উদ্দেশ্যে পারস্পারিক সহায়তা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন। তাই তাকাফুলের উদ্দেশ্য আমরা এভাবে বলতে পারি: একটি বীমা পলিসি নির্দিষ্ট কিছু অসহায় লোককে ভবিষ্যতের বস্তুগত ঝুঁকি থেকে উদ্ধার করবে, যা সেই সব লোককে কঠিন অবস্থায় নিয়ে যেতে পারতো। মহানবী (স.) মানুষের কষ্ট দূর করতে এগিয়ে আসার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেন, যে কোন ব্যক্তি ঈমানদারের জাগতিক কষ্ট দূর করে দেবে, আল্লাহপাক তাকে আখেরাতের একটি কষ্ট দূর করে দেবেন, যে কোন অভাবী লোকের অভাব মোচন করে দেবে। আল্লাহপাক এই দুনিয়া এবং আখেরাতে তাকে নাজাত দেবেন।
বীমা পলিসির মাধ্যমে পারস্পারিক সহযোগিতা এবং ভ্রাতৃত্ব বোধের চেতনা সেই সাথে সংগতির প্রকাশের মাধ্যমে অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায়। এ ধরণের অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে অবশ্যই ভ্রাতৃত্ববোধ মজবুত করে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্বনির্ভরতা এনে দেয়। এখানে আল্লাহপাক পারস্পারিক সাহায্যের অনুশীলনের কথা বলেছেন।
বীমা পলিসি আত্মনির্ভরশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে। এ ধরণের একটি বীমা পলিসি বীমা গ্রাহককে অপ্রত্যাশিত বিপদ, ক্ষতি বা লোকসান থেকে বস্তুগতভাবে রক্ষা করে। বস্তুগত নিরাপত্তার ফলে বীমা গ্রাহককে কঠিন পরিস্থিতিতে অন্যদের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল করে না। এ ব্যাপারে আল্লাহপাক সব সময়ই জীবনকে সহজ ও স্বস্তিদায়ক করতে চান। বীমা পলিসি হবে আল-মুদারাবা অর্থনৈতিক পদ্ধতির মূলনীতিভিত্তিক যেখানে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো চুক্তি অনুযায়ী লাভের অংশ পাবে।
জীবন বীমা পলিসির ক্ষেত্রে অনেক আলেম প্রায়ই ভুল বুঝে বলে থাকেন, এই লেনদেনের মাধ্যমে কারো জীবন ও ভগ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে। এ ধরণের ভুল ধারণা অবশ্যই ভিত্তিহীন। কারণ জীবন বীমা পলিসি এমন একটি ব্যবস্থা যার লক্ষ্য থাকে, কারো মৃত্যু (পলিসিহোল্ডার বা বীমা গ্রাহক) হলে তার অসহায় পোষ্যদের বস্তুগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের মঙ্গল করা। আমির বিন সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের সম্পদশালী অবস্থায় রেখে যাও, যাতে তারা অন্যের সাহায্য প্রার্থনা না করে।
জীবন বীমা পলিসি মৃতের (বীমা গ্রাহক) বিধবা স্ত্রী এবং অন্য পোষ্যদের ভবিষ্যতের বস্তুগত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। মহানবী (স.) বাস্তব প্রয়োজনেই সমাজের বিধবা ও দরিদ্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। হাদীসে বলা হয়েছে-
"সাফওয়ান বিন সালিম (রা.) হতে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, যে ব্যীক্ত বিধবা এবং দরিদ্র ব্যক্তির জন্য কার করে ও দেখাশুনা করে, সে আল্লাহ'র পথে জিহাদকারী মুজাহিদ। কিংবা যে ব্যক্তি দিনে রোজা রাখে এবং সারা রাত ইবাদত করে তার মতো।"
জীবন বীমা পলিসি অন্যদের মতো এতিমদের ও ভবিষ্যতের বস্তুগত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় এবং এটা মহানবী (স.) এর একটি হাদীসের দ্বারাও প্রমাণিত। তিনি মানুষদের আখেরাতে আরো বড় পুরস্কারের জন্য এতিমদের নিরাপত্তা দেওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। "সহল বিন সা'দ (রা.) হতে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেন, আমি এবং সেই ব্যক্তি যে এতিমদের দেখাশুনা করে এবং তাদের নিরাপত্তা দেয়, সে বেহেশতে এইভাবে থাকবো (দুই আংগুল প্রদর্শন করে দেখিয়েছেন) ।
বীমা পলিসিতে তার নিজস্ব বাস্তবতা আছে, এই অর্থে যে, বীমা গ্রহীতা অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি থেকে সাধারণভাবে নিরাপদ থাকে এবং এর ফলে সমাজের অনেক ব্যক্তি ভবিষ্যতের যে কোন ক্ষতি বা লোকসানের ভয় থেকে মুক্ত থেকে আইনসম্মত যে কোন লেনদেনে সম্পৃক্ত হতে বিব্রত করে না। আল্লাহপাক সব সময়ই যে কোন বৈধ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে মানুষদের উৎসাহিত করে, তিনি বলেন, আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে নিষিদ্ধ করেছেন (আল কুরআন) ।