'ক্যাট বন্ড' হতে পারে দুর্যোগ মোকাবিলার হাতিয়ার

অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক: ক্যাটাস্ট্রফিক বন্ড (Catastrophe Bond বা Cat Bond) বাংলাদেশে এখনও ব্যবহৃত হয়নি, কিন্তু এটি দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় খুব শক্তিশালী একটি আর্থিক হাতিয়ার হতে পারে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় সঠিকভাবে এগোলে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী, কৃষি খাত ও অবকাঠামোকে ভবিষ্যতের সিডর, আইলা, মোরা ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের বড় ক্ষতি থেকে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। স্পষ্ট ও বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনাটা নিচে তুলে ধরা হল।
ক্যাটাস্ট্রফিক বন্ড কী?
এটি একটি বীমা-সম্পৃক্ত বিনিয়োগ বন্ড। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা টাকা বিনিয়োগ করে। নির্দিষ্ট দুর্যোগ ঘটলে বা ক্ষতি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হলে বন্ডের অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের পুনর্বাসনে সরাসরি ব্যবহার করা হয়। দুর্যোগ না ঘটলে বিনিয়োগকারী লাভসহ টাকা ফেরত পায়।
ফলাফল: সরকার এককালীন বড় ক্ষতিপূরণের জন্য আগেভাগেই টাকা নিশ্চিত রাখতে পারে, ত্রাণ-নির্ভরতা কমে।
বাংলাদেশ কীভাবে এটি কাজে লাগাতে পারে
১. ঝুঁকি মূল্যায়ন করে সঠিক কাঠামো তৈরি
সাইক্লোন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের ডেটা ব্যবহার। কোন ক্ষতির স্তরে বন্ড কার্যকর হবে, তা আগেই নির্ধারণ। আবহাওয়া সূচক ভিত্তিক (Parametric trigger) করা উচিত এতে ক্ষতির হিসাব নিয়ে বিতর্ক কমবে এবং দ্রুত অর্থ ছাড় করা যাবে।
২. সরকারের নেতৃত্বে Catastrophe Risk Pool গঠন
দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোকে এক ফান্ডের আওতায় আনা। বীমা কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রি-ইন্স্যুরারের অংশগ্রহণ। IDRA ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে রেগুলেশন নির্ধারণ।
৩. আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে বন্ড ইস্যু
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), Swiss Re, Munich Re ইত্যাদির পরামর্শে গ্লোবাল মার্কেটে ইস্যু করা। শেয়ারবাজারের মত বিনিয়োগ আকর্ষণ করে তহবিল বড় করা। ESG বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পরিবেশ-সহনশীল উন্নয়ন পরিকল্পনা সংযুক্ত করা।
৪. Climate-resilient অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার
বন্ড থেকে পাওয়া অর্থ শুধু টেকসই প্রকল্পে ব্যবহার। সাইক্লোন শেল্টার, নদীবাঁধ শক্তিশালীকরণ, উপকূলীয় আবাসনের উঁচু বেজ, RCC নির্মাণ, সেচ ও লবণ-সহিষ্ণু কৃষির প্রযুক্তি উন্নয়ন। এগুলো ভবিষ্যৎ ক্ষতি কমায় এবং বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়ায়।
৫. স্বচ্ছতা ও শক্তিশালী তদারকি
বন্ডের অর্থ কোথায় খরচ হলো, প্রযুক্তি দিয়ে ট্র্যাকিং প্রয়োজন, অডিট রিপোর্ট নিয়মিত প্রকাশ, স্বাধীন তৃতীয় পক্ষের যাচাই মানুষ এবং বিনিয়োগকারী দু’পক্ষেরই আস্থা নিশ্চিত হবে।
৬. সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরাসরি সহায়তা
দুর্যোগের পর পুনর্বাসনে ক্যাট বন্ডের অর্থ: ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নগদ সহায়তা। কৃষক ও মৎস্যজীবীদের তাৎক্ষণিক আর্থিক নিরাপত্তা। ক্ষুদ্র ব্যবসার পুনরায় দাঁড়ানোর তহবিল। ত্রাণের ধীরতা ও অপব্যবস্থাপনা অনেকটাই কমে যাবে।
বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সুবিধা কীভাবে কাজে লাগবে
বড় দুর্যোগে জরুরি অর্থের নিশ্চয়তা ঋণ-নির্ভরতা কমবে। বিনিয়োগকারীর ঝুঁকি বাংলাদেশে ভাগ হয়ে যাবে অর্থনীতি নিরাপদ থাকবে। উপকূলে মানুষের আস্থা বাড়বে বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকি ও দরিদ্রতা কমবে। আন্তর্জাতিক মহলে জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতার প্রমাণ উন্নয়ন অংশীদারদের সমর্থন বাড়বে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
দুর্বল ডেটা ও ঝুঁকি মূল্যায়ন আবহাওয়া ও স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহারে বিনিয়োগ। প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ঘাটতি তথ্য উন্মুক্ততা এবং শক্ত রেগুলেশন। বিনিয়োগকারী আস্থা গড়তে সময় লাগে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা।
বাংলাদেশ বারবার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সামনে পড়ে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থভাণ্ডারে চাপ বাড়ে। ক্যাটাস্ট্রফিক বন্ড সরকারকে দুর্যোগের আগেই অর্থের নিরাপদ ব্যবস্থা করে দেয়, যাতে হাজারো জীবন ও জীবিকা দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যায়। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শক্ত পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব থাকলে বাংলাদেশ এই উদ্ভাবনী ফাইন্যান্স টুল ব্যবহার করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় একটি বৈশ্বিক মডেল হতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 (1).gif)


