আর্থিক নিরাপত্তা না হয়ে কেন ভয়ের প্রতীক হচ্ছে বীমা

রাজ কিরণ দাস: বীমা এমন একটি আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, যা মানুষকে অনিশ্চয়তার মুহূর্তে আশ্বাস দেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি অনেক সময় বীমা কোম্পানির অসদাচরণের কারণে ভেঙে পড়ে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের দায় এড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে দাবি নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ঘটায়, ন্যায্য দাবিকে অস্বীকার করে, কিংবা কম অর্থ প্রদানের মাধ্যমে গ্রাহকদের প্রতারিত করে। এই অনৈতিক আচরণই বীমা ক্ষেত্রে খারাপ আচরণ বা ব্যাড ফেইথ ইন্স্যুরেন্স হিসেবে পরিচিত।

একজন পলিসিধারী যখন সঠিকভাবে দাবি করেন, তখন তার প্রত্যাশা থাকে যে- বীমা কোম্পানি ন্যায্যতা ও সততার সঙ্গে সেটি নিষ্পত্তি করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক প্রতিষ্ঠান দাবির প্রক্রিয়া জটিল করে তোলে। কখনও কারণহীন বিলম্ব, কখনও অপ্রয়োজনীয় নথির দাবি, আবার কখনও পলিসির ভাষা বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে গ্রাহককে বিভ্রান্ত করে। এমনকি কেউ কেউ গ্রাহকের বৈধ দাবিও বাতিল করে দেয়, যেন ক্ষতিপূরণ না দিতে হয়। এই ধরনের আচরণ শুধু পেশাগত দায়িত্ব লঙ্ঘন নয়, এটি আইনবিরোধীও।

অনেক সময় ভোক্তাদের অধিকাংশই বীমা চুক্তির জটিল আইনি ভাষা বোঝেন না। ফলে কোম্পানির ভুল ব্যাখ্যা বা অস্পষ্ট জবাব অনেক সময় গ্রাহকের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে হতাশ হয়ে দাবি ত্যাগ করেন, যা বীমা কোম্পানির পক্ষে সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বীমা আইনের মূল নীতি স্পষ্ট- কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না এবং গ্রাহকের প্রতি সদিচ্ছা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক।

যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে দাবি বিলম্বিত করে বা অযৌক্তিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সেটি খারাপ আচরণের পর্যায়ে পড়ে। এ ধরনের আচরণের শিকার হলে প্রথমেই প্রয়োজন সচেতনতা ও প্রমাণ সংরক্ষণ। প্রত্যেকটি যোগাযোগ, লিখিত উত্তর, ইমেইল বা ফোনালাপ নথিবদ্ধ রাখা জরুরি। কারণ, এই প্রমাণই ভবিষ্যতে আইনি পদক্ষেপের ভিত্তি তৈরি করে।

এ অবস্থায় সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো অভিজ্ঞ বীমা আইনজীবীর পরামর্শ নেয়া। একজন পেশাদার আইনজীবী বীমা নীতির ভাষা বিশ্লেষণ করে কোম্পানির অন্যায় আচরণ প্রমাণ করতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্য নিষ্পত্তি আদায় বা আদালতে মামলা দায়েরের পথ দেখাতে পারেন। আইনজীবীর হস্তক্ষেপ অনেক সময় কোম্পানিকে দ্রুত সমঝোতায় আসতে বাধ্য করে।

বীমা শিল্প একটি বিশ্বাসভিত্তিক খাত। এখানে প্রতিশ্রুতি ও ন্যায্যতার জায়গায় যদি প্রতারণা ও বিলম্ব স্থান নেয়, তবে পুরো ব্যবস্থার ওপরই মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। তাই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোরও উচিত নিয়মিত নজরদারি ও কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে বীমা কোম্পানিগুলোকে দায়বদ্ধ রাখা। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে- যেন কোনো প্রতিষ্ঠান ইচ্ছামতো তাদের ক্ষতি করতে না পারে।

শেষ পর্যন্ত বিষয়টি ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতার। একজন গ্রাহক তার কষ্টার্জিত অর্থে সুরক্ষার আশায় বীমা করেন; সেই সুরক্ষা যেন অন্যায় আচরণের কারণে হারিয়ে না যায়। তাই প্রয়োজন সময়োচিত আইনি পদক্ষেপ, পেশাদার পরামর্শ ও জনসচেতনতা।

যদি কেউ মনে করেন, তার বীমা দাবি অন্যায়ভাবে বিলম্বিত বা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, তবে নীরব থাকা নয়- আইনের দ্বারস্থ হওয়াই একমাত্র সঠিক পথ। বীমা খাতে খারাপ আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেই কেবল প্রতিষ্ঠিত হবে এক ন্যায্য, স্বচ্ছ ও মানবিক বীমা ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি গ্রাহকের অধিকারই হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।