ঝুঁকি বাড়ছে, পুনর্বীমার গুরুত্বও বাড়ছে: ২০২৫ সালে বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষণ

রাজ কিরণ দাস: ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক পুনর্বীমা বাজারকে আর কেবল একটি সহায়ক আর্থিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি এখন বৈশ্বিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দুর্যোগ-পরবর্তী পুনরুদ্ধার সক্ষমতার এক অপরিহার্য স্তম্ভ। আন্তর্জাতিক বীমা তদারকি সংস্থা আইএআইএস’র সর্বশেষ সমন্বিত বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে বৈশ্বিক পুনর্বীমা বাজারের আকার পৌঁছেছে প্রায় ১.৭৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা ২০২৫ সালে বাজারের কাঠামোগত শক্তি ও ভবিষ্যৎ প্রবণতা বোঝার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করেছে।
এই পরিসংখ্যান কেবল আকারগত প্রবৃদ্ধির গল্প নয়; বরং এটি পুনর্বীমা শিল্পের ভূমিকার রূপান্তরকে প্রতিফলিত করে। বৈশ্বিক মোট বীমা প্রিমিয়ামের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এখন পুনর্বীমার মাধ্যমে প্রবাহিত হচ্ছে, যা স্পষ্ট করে দেয় যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি-পরবর্তী অনিশ্চয়তা এবং ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির যুগে সরাসরি বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো একা ঝুঁকি বহন করতে পারছে না। ঝুঁকি ছড়িয়ে দেয়া ও মূলধন সুরক্ষার ক্ষেত্রে পুনর্বীমা এখন অর্থনীতির গভীর স্তরে প্রোথিত।
আইএআইএস’র ব্যবহৃত দুটি তথ্যভান্ডার- এসডব্লিউএম রিইন্স্যুরেন্স কম্পোনেন্ট এবং গ্লোবাল রিইন্স্যুরেন্স মার্কেট সার্ভে (জিআরএমএস)-২০২৫ সালে এসে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গভাবে এসডব্লিউএম কাঠামোর আওতায় তথ্য রিপোর্ট করায় সাম্প্রতিক বছরগুলোর বাজারচিত্র আগের তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত ও বাস্তবসম্মত হয়েছে। ফলে ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রিমিয়ামের বড় উল্লম্ফনকে সরল প্রবৃদ্ধি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই; বরং এটিকে ডেটা কভারেজের সম্প্রসারণ এবং বাজারের প্রকৃত আকার উন্মোচনের প্রতিফলন হিসেবেই ব্যাখ্যা করতে হয়। তবুও, নিট পুনর্বীমা প্রিমিয়াম ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করে যে পুনর্বীমাকারীরা কেবল প্রিমিয়াম আদায় করছে না, বাস্তবে তারা বড় অঙ্কের ঝুঁকি নিজেদের ব্যালান্স শিটে ধারণ করছে।
২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক বিশ্লেষণ বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। আমেরিকা অঞ্চল এখনও বৈশ্বিক পুনর্বীমা বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা জলবায়ুজনিত দুর্যোগ ঝুঁকি, বড় করপোরেট বীমা চাহিদা এবং পুঁজিবাজারভিত্তিক ঝুঁকি স্থানান্তর ব্যবস্থার ঘনত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। একই সঙ্গে ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত অংশগ্রহণ বাজারকে আরও বহুমাত্রিক করেছে। এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ২০২৫ সালে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য যেমন ঝুঁকি পর্যবেক্ষণকে জটিল করে তুলছে, তেমনি এটি বাজারের স্থিতিস্থাপকতাও বাড়াচ্ছে।
পুনর্বীমা খাতের আর্থিক ভিত্তি বিশ্লেষণে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক দিক হলো এর শক্তিশালী সলভেন্সি অবস্থান। ২০২৪ সালের শেষে পুনর্বীমাকারীদের মূলধনী সক্ষমতা সুদৃঢ় ছিল, যা ২০২৫ সালে প্রবেশের সময় বাজারকে একটি তুলনামূলক নিরাপদ অবস্থানে রেখেছে। করপোরেট ঋণে উচ্চমাত্রার বিনিয়োগ একটি রক্ষণশীল কিন্তু কার্যকর কৌশলের ইঙ্গিত দেয়, যা স্থিতিশীল নগদ প্রবাহ নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে শেয়ার, সরকারি বন্ড ও বিকল্প সম্পদে সীমিত কিন্তু কৌশলগত উপস্থিতি বাজারকে দীর্ঘমেয়াদে মুনাফা ধরে রাখার সুযোগ দিচ্ছে। এই বিনিয়োগ কাঠামো দেখায় যে পুনর্বীমা শিল্প এখন ঝুঁকি ও রিটার্নের মধ্যে আরও পরিমিত ভারসাম্য খুঁজছে।
নন-লাইফ পুনর্বীমা বাজারের কম্বাইন্ড রেশিও ২০২৪ সালে ৯৫ শতাংশে স্থিতিশীল থাকা ২০২৫ সালের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। ২০২২ সালে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পর এই স্থিতি প্রমাণ করে যে আন্ডাররাইটিং শৃঙ্খলা, মূল্য নির্ধারণে কঠোরতা এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজার ধীরে ধীরে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। এটি কেবল স্বল্পমেয়াদি লাভজনকতার প্রশ্ন নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদে মূলধন সংরক্ষণ এবং বড় বিপর্যয়ের ধাক্কা সামাল দেয়ার সক্ষমতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
২০২৫ সালের বাস্তবতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- এই শক্ত ভিত্তি কতটা টেকসই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের ঘনত্ব ও তীব্রতা বাড়ছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, আর একই সঙ্গে বৈশ্বিক সুদের হার, ক্রেডিট ঝুঁকি ও আর্থিক বাজারের অস্থিরতা পুনর্বীমা খাতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। এই প্রেক্ষাপটে পুনর্বীমা শিল্পের সামনে কেবল আকার বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নেই; রয়েছে দায়িত্বশীলভাবে ঝুঁকি গ্রহণ, স্বচ্ছ রিপোর্টিং এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূলধন ব্যবস্থাপনার বাধ্যবাধকতা।
সবকিছু মিলিয়ে, ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক পুনর্বীমা বাজার একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে- ঝুঁকি যত জটিল ও ব্যাপক হচ্ছে, পুনর্বীমার প্রয়োজন ততই মৌলিক হয়ে উঠছে। শক্তিশালী মূলধন, উন্নত তদারকি, শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্ডাররাইটিং এবং টেকসই বিনিয়োগ কৌশল যদি বজায় থাকে, তবে পুনর্বীমা শিল্প শুধু বৈশ্বিক বীমা ব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসেবেই নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার নীরব ভিত্তি হিসেবেও তার ভূমিকা আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করবে।




