শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব: বিএম ইউসুফ আলী
লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা বাড়িয়ে প্রবিধান জারি করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত প্রবিধান জনমত যাচাইয়ের জন্য ওয়েবসাইটে তুলে দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) । ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ানোর এ প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে বীমা অঙ্গনে। মতামত আসতে থাকে পক্ষে-বিপক্ষে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার এ ধারাকে প্রবাহমান করতে বীমাখাতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের মতামত নেয়ার উদ্যোগ নেয় ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি। এ ধারাবাহিকতায় এ পর্যায়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট ও পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স এর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম ইউসুফ আলী।
ভিত্তি হিসেবে জানতে চাওয়া হয়:
ক. বিভিন্নখাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আপনার দৃষ্টিতে তা কতটা বাড়ানো যৌক্তিক?
খ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা না বাড়িয়ে কোম্পানি পরিচালনায় ব্যয় কমিয়ে এনে ব্যবসা পরিচালনা করলে সার্বিক দিক থেকেই মঙ্গলজনক- বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
গ. বিশেষজ্ঞদের অভিমত: ব্যয়সীমা বাড়ালে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে আরও বেশি টাকা খেয়ে ফেলার সুযোগ পাবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
ঘ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমার প্রস্তাবে ব্যয়ের যে হার নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে- এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত কি?
ঙ. বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে ব্যবসা উন্নয়নে ব্যয়ের সীমা বাড়ানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
চ. ব্যবস্থাপনা ব্যয়সীমা আরো বাড়ালে আর্থিকভাবে দুর্বল কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কার বিষয়ে আপনার মতামত কি?
** আমি মনে করি এটা যৌক্তিক। ৫৮ সালের প্রবিধানটি প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর আগের। যে সময় এ প্রবিধান হয়েছে সে সময়ের তুলনায় এখন জীবন যাত্রার মানের অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমার এমপ্লয়ীদের সেলারি বেড়েছে, বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় বেড়েছে। প্রিমিয়াম রেট কিন্তু আমার বাড়েনি। তাই এখনকার ব্যয় মেটাতে ব্যয়সীমা বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা অবশ্যই যৌক্তিক।
নবায়নে ব্যয় বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে তার পিছনে একটি উদ্যেশ্য রয়েছে। নবায়ন কমিশন কম হওয়ায় এজেন্টরা নবায়ন সংগ্রহে আগ্রহী হয় না। ফলে নবায়ন সংগ্রহ আমাদের দেশে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি হয় না। নবায়নে ব্যয় বাড়ানো হলে নবায়ন সংগ্রহে এজেন্ট ও মাঠ পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মীরা উৎসাহিত হবে। একারণে নবায়নে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বীমা আইন ২০১০ অনুসারে নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহে ৩য় বর্ষ থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে ৫ শতাংশ। আইনের এ ধারাটিরও সংশোধনে উদ্যোগ নিতে হবে।
** কোম্পানি পরিচালনায় অনেক ব্যয় নতুন এসেছে। যা আগে ছিল না। নিবন্ধন ফি বাড়নো হয়েছে, ভ্যাট দিতে হচ্ছে, ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এসব ব্যয় কমানো হলে ব্যয় অনেক কমে যাবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি নির্ধারিত বিভিন্ন ব্যয় কমাতে আইডিআরএ উদ্যোগ নিতে পারে।
ব্যয় বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা সামগ্রিকভাবে। এটা একক কোনো কোম্পানির জন্য না। ফলে কোম্পানি তার নিজস্ব পরিচালনা দক্ষতার উপর ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিতে পারে। কোনো কোনো কোম্পানির মাঠ পর্যায়ের সাংগঠনিক কাঠামো ৩ স্তরের হলেও অন্যান্য পদে কারো বেশি, কারো কম। যাদের সাংগঠনিক কাঠামো কম তাদের ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। আর একটি বিষয়, যে কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় যতো বাড়বে তার ব্যয় ততো কমবে। সে গ্রাহক, শেয়ারহোল্ডারকে ততো বেশি মুনাফা দিতে পারবে। গ্রাহককে যে কোম্পানি যতো বেশি মুনাফা দিতে পারবে তার ততো বেশি সুনাম হবে। ব্যবসার প্রসার হবে। এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো ব্যয় বাড়ানোর বিষয়টি এমন নয় যে আইনের সীমা পর্যন্তই তাকে ব্যয় করতে হবে। ব্যয় কম করলে তো আইন তাকে ধরছে না। বরং কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট প্রশংসার দাবিদার।
** আমরা ব্যয়ের হার বাড়ানোর যে প্রস্তাব করেছি তা হলো নতুন কোম্পানি যাতে সার্ভাইভ করতে পারে এ দিকটি বিবেচননায় নিয়ে। আরেকটি বিষয় '৫৮ সালের বিধিমালা অনুসারে কেউ নির্ধারিত সীমার ভিতর থাকতে পারছে না। ফলে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ছে। এতে বীমাখাতে এক ধরণের বিশৃংখলার সৃষ্টি হচ্ছে। অবৈধভাবে ব্যয়ের প্রবণতা তৈরি হলে তখন এক ধরনের মানসিকতা কাজ করে। এক টাকা অবৈধ ব্যয় করলেও যা, ১০ টাকা ব্যয় করলেও তা। তাই আমরা লাইফ বীমাখাতে একটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি। এরপর কেউ অতিরিক্ত ব্যয় করলে আইডিআরএ কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবে।
** ব্যয়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে গ্রাহক স্বার্থ কোনভাবে ক্ষুণ্ণ হবে বলে আমরা মনে করি না। কারণ এখন ব্যাংক রেট আছে তা এখনকার একই অবস্থায় থাকবে এমন নিশ্চয়তা নেই। ভবিষ্যতে ব্যাংক রেট বাড়তে পারে, তাছাড়া লাভজনক খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এতে খরচ বাদ দিয়ে বিনিয়োগ থেকে যে আয় হবে তাতে গ্রাহককে মুনাফাসহ টাকা দেয়া সম্ভব হবে।
এছাড়া বিনিয়োগের এখন অনেক খাত সৃষ্টি হয়েছে। নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ভালো মুনাফা দিচ্ছে। আর প্রবিধানটি করা হলে তা পরিবর্তন করা যাবে না এমনটি নয়। এখনকার বাস্তবতার ভিত্তিতে এ প্রস্তাব করা হয়েছে। বাস্তবতার আলোকে প্রয়োজনে পরবর্তীতে এ ব্যয় সীমায় আবারো পরিবর্তন আনা সম্ভব। অর্থাৎ কমানো সম্ভব।
** লাইফ খাতের বাজার পরিস্থিতি খুব ভাল যাচ্ছে না। অনেক কোম্পানির আর্থিক ভিত খুব দুর্বল। বেশ কিছু কোম্পানি রয়েছে তারা ক্লেইম দিতে হিমসীম খাচ্ছে। এর মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়ের অভিযোগ উঠছে। ফলে বাজারে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশৃঙ্খল অসুস্থ প্রতিযোগিতার এ বাজারে উন্নয়নের জন্য প্রথমেই বাজারকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কেউ ব্যয় সীমার মধ্যে থাকতে পারছে না। এর বড় একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা চাচ্ছি এর থেকে বেড়িয়ে আসতে। যাতে সবাই আইনের মধ্যে আসতে পারে। মূলত ব্যয় বাড়ানোর যে প্রস্তাব তা বাজারকে শৃঙ্খলায় আনার উদ্যেশেই করা হয়েছে।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কথা যদি বলেন, তাহলে আমার কোম্পানির ক্ষেত্রে বলতে পারি- আমি আমার কোম্পানির ব্যয় কমিয়েছি। আমি তো ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও ব্যয় বাড়াব না। আমি প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার চিন্তা করবো। কোনো কোম্পানির ব্যবসা বাড়লে তার ব্যয়ের অনুপাত কমে আসবে এটাই স্বাভাবিক।
** এটা নির্ভর করবে কোম্পানি ম্যানেজমেন্টে যারা আছে তারা কিভাবে কোম্পানি পরিচালনা করছে তার ওপর। প্রিমিয়াম আয় বাড়াতে না পারলে কোনো কোম্পানির আর্থিক ভিত শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ নেই। তাই কোম্পানিগুলোর উচিত হবে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধি করে কোম্পানির প্রিমিয়াম আয় বাড়ানো। যাতে আর্থিক ভিত শক্তিশালী হয়। ব্যয় করার সুযোগ পাব বলেই আর্থিক ভিতের বিবেচনা না করে ব্যয় করে যাব, এটা কোনো স্বাভাবিক চিন্তা না।