আইডিআরএ’র তদন্ত

সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন করেছে ৭ নন-লাইফ বীমা কোম্পানি

আবদুর রহমান আবির: সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন করেছে নন-লাইফ বীমা খাতে ৭টি কোম্পানি। এসব কোম্পানির কোনটিই সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা অনুসারে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ করেনি। এমনকি সরকারি সিকিউরিটিজে কোন বিনিয়োগ নেই এমন কোম্পানিও রয়েছে এই তালিকায়।

আইন বলছে, নন-লাইফ বীমা কোম্পানির সম্পদের অন্যূন ৭.৫০% সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ করতে হবে। সম্পদের বাকী অংশ ৯টি খাতে নির্ধারিত হারে বিনিয়োগ করা যাবে। নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা, ২০১৯ এর ৪ নং ধারায় বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের শর্ত লঙ্ঘন করা বেসরকারি খাতের নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো হলো- ইস্টার্ণ ইন্স্যুরেন্স, নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স এবং এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) পরিচালিত বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ২০২৩ সালের বিভিন্ন সময় নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ সরেজমিন যাচাইপূর্বক এসব প্রতিবেদন প্রস্তুত করে কর্তৃপক্ষের তদন্ত দল।

বিনিয়োগ বিধি লঙ্ঘন করায় এর আগে ৪টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিকে ৫ লাখ টাকা করে মোট ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে আইডিআরএ। কোম্পানিগুলো হলো- মেঘনা ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স এবং অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স। ২০২৪ সালের বিভিন্ন সময় এই জরিমানা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।

উল্লেখ্য, সম্পদ বিনিয়োগ সংক্রান্ত বীমা আইন ২০১০ এর ৪১ ধারা লঙ্ঘন করলে আইনের ১৩২ ধারা অনুসারে অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা যায়। তবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ১৩০ ও ১৩৪ ধারা অনুসারে কোম্পানিগুলোকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিকিউরিটিজ বন্ড সবচেয়ে সুরক্ষিত হলেও দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিগুলো এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায় না। তাই দীর্ঘ দিন ধরে অনেক কোম্পানি এই আইন লঙ্ঘন করে আসছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করা বা নিয়ম লঙ্ঘনকারী কোম্পানিগুলোকে শাস্তি দিতে না পারাকে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা হিসেবে অভিহিত করছেন।

তাদের মতে, সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের বিধান লঙ্ঘনকারী কোম্পানিগুলোকে বীমা আইনের ১৩০ ও ১৩২ ধারার যেকোনটির অধীনে শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের ১৩০ ধারা অনুসারে অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং লঙ্ঘন অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা যেতে পারে।

এ ছাড়াও সম্পদ বিনিয়োগের বিধান লঙ্ঘন করায় বীমা আইনের ১৩২ ধারা অনুসারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। একইসঙ্গে এই বিধান লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের ১৩৪ ধারা মোতাবেক সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে।

আইডিআরএ’র তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ২৬৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ করেছে ১৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটি বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের ৬.৪৩ শতাংশ।

এই হিসাবে নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালায় বেঁধে দেয়া সীমার চেয়ে ১.০৭ শতাংশ কম বিনিয়োগ করেছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে।

ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের প্রকৃত মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৯০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ করেছে ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা ৬.৩৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা লঙ্ঘন করেছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স।

এ বিষয়ে বীমা কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোকাররম দস্তগীর বলেন, ইসলামী বীমা কোম্পানি হিসেবে আমাদের সুদ ভিত্তিক বিনিয়োগে যাওয়ার সুযোগ নেই। অথচ বর্তমান বিনিয়োগ বিধি আমাদেরকে সুদি বিনিয়োগে বাধ্য করছে। আমরা আইডিআরএ’র কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছি। কিন্তু ইসলামী বীমার আইন না থাকায় তারাও আমাদের কোন নির্দেশনা দিতে পারছে না।

মোকাররম দস্তগীর আরো বলেন, এরইমধ্যে আমরা আইডিআরএ’র নির্দেশনা অনুসারে বিনিয়োগ বিধির শর্তাদি পূর্ণ করতে সরকারি সিকিউরিটিজে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করেছি। তবে ইসলামী বীমা কোম্পানি হিসেবে আমাদের অবশ্যই শরীয়া বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে বিনিয়োগ করতে হবে। আর শরীয়া ভিত্তিক বিনিয়োগ-ই আমাদের জন্য লাভজনক বলে আমরা মনে করি, বলেন তিনি।

পিপলস ইন্স্যুরেন্স সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেছে ১১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। যা কোম্পানিটির বিনিয়োগযোগ্য মোট সম্পদের ৫.৩৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি ২.১৭ শতাংশ কম বিনিয়োগ করে আইনের বিধান লঙ্ঘন করেছে।

কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৫ কেটি ৮৮ লাখ টাকা। তবে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে কোম্পানিটি বিনিয়োগ করেছে ২ কোটি  ৫০ লাখ টাকা। যা বীমা কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগের ২.০২ শতাংশ।

এক্ষেত্রে কোম্পানিটি নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা লঙ্ঘন করে সরকারি সিকিউরিটিজে ৫.৪৮ শতাংশ কম বিনিয়োগ করেছে।

ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করেছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের ১.৮৪ শতাংশ। এই হিসাবে কোম্পানিটি নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালায় বেঁধে দেয়া সীমার চেয়ে ৫.৬৬ শতাংশ কম বিনিয়োগ করেছে।

এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে সর্বমোট বিনিয়োগ করেছে ৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকাই কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন। এক্ষেত্রে প্রকৃত বিনিয়োগ ৫০ লাখ টাকা, যা কোম্পানিটির বিনিয়োগযোগ্য মোট সম্পদের ০.৫৯ শতাংশ।

সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে কোন বিনিয়োগ করেনি ইস্টার্ণ ইন্স্যুরেন্স- এমন তথ্য উঠে এসেছে আইডিআরএ’র সম্পদ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে আরো বলা হয়, কোম্পানিটি নন-লাইফ বীমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা ২০১৯ এর বিধান সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করেছে।

এ বিষয়ে ইস্টার্ণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান তারেক বলেন, কর্তৃপক্ষের তদন্ত চলাকালে সরকারি সিকিউরিটিজে আমাদের কোন বিনিয়োগ ছিল না। তবে এরইমধ্যে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। প্রবিধানে নির্ধারিত বিনিয়োগসীমার চেয়ে এখন বেশিই বিনিয়োগ করা হয়েছে সরকারি সিকিউরিটিজে।

ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে তিনি আরো বলেন, কর্তৃপক্ষে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সংক্রান্ত শুনানিতে আমাদের ১৫ কোটি টাকা সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করতে বলা হয়েছিল। তবে এরইমধ্যে আমরা খাতটিতে ১৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সকল তথ্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম এর আগে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে জানান, নন-লাইফ বীমা খাতের বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের প্রকৃত অবস্থা জানতে ২০২২ সালে কোম্পানিগুলোর অফিস পরিদর্শন করে কর্তৃপক্ষের পরিদর্শন দল। এতে বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে বিনিয়োগের বিধান লঙ্ঘনসহ নানান অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।

পরবর্তীতে এসব অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষে দ্বিপক্ষীয় শুনানি হয় এবং বিনিয়োগের বিধান লঙ্ঘন করার অপরাধে ৪টি নন-লাইফ বীমা কোম্পানিকে জরিমানা করা হয়। এরইমধ্যে কোম্পানিগুলো জরিমানার অর্থ পরিশোধ করেছে বলে জানান জাহাঙ্গীর আলম।