বীমার শর্তাবলি না বুঝলে ক্ষতির দায় গ্রাহকের
রাজ কিরণ দাস: বীমা আজ আর কেবল একটি কাগুজে চুক্তি নয়। এটি জীবনের নিরাপত্তা, আর্থিক স্থিতি ও মানসিক প্রশান্তির প্রতীক। আধুনিক জীবনের অনিশ্চয়তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ঘটনা ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থার যুগে বীমা এক প্রকার নীরব সহায়ক, যা বিপদের সময় হাতে তুলে দেয় ভরসার হাত। তবু আমাদের সমাজে বীমা এখনো এক প্রকার অবহেলিত ধারণা, যা কেবল বাধ্যতামূলক পরিস্থিতিতে বিবেচিত হয়।
বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ মানুষ বীমার প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝেন না। তাঁরা মনে করেন, এটি কেবল অর্থ অপচয়ের একটি উপায়। অথচ বীমার আসল শক্তি লুকিয়ে আছে পরিকল্পিত সুরক্ষায়। সঠিক পলিসি থাকলে আকস্মিক দুর্ঘটনা বা অসুস্থতা পরিবারের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দিতে পারে না। কিন্তু ভুল বা অপর্যাপ্ত পলিসি নেওয়ার কারণে অনেকেই বিপদের মুহূর্তে বুঝতে পারেন, সুরক্ষার ছাতাটি আসলে ছিদ্রযুক্ত ছিল।
বীমা গ্রহণের আগে নিজের প্রয়োজন ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই একই পলিসি থেকে সমান উপকার পাবেন না। কারও জন্য স্বাস্থ্য বীমা প্রাধান্য পেতে পারে, আবার কারও জন্য জীবন বীমা বা সম্পত্তি বীমা বেশি কার্যকর। সমস্যা হলো, অনেকেই এই বিশ্লেষণ না করেই কেবল পরিচিত কারও পরামর্শে বীমা নেন, যার ফলশ্রুতিতে প্রকৃত প্রয়োজন পূরণ হয় না।
আরও একটি বড় সমস্যা হলো অজ্ঞতা ও অর্ধেক জ্ঞান। বীমার শর্তাবলি ও সীমাবদ্ধতা না বুঝেই অনেকেই সই করে ফেলেন। পরবর্তীতে দাবি করার সময় বুঝতে পারেন, প্রয়োজনীয় ঝুঁকিগুলো পলিসির আওতায়ই নেই। এই ভুলটি শুধুমাত্র ব্যক্তির নয়; বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বও কম নয়। তাদের উচিত প্রতিটি শর্ত ও ঝুঁকি সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা, যাতে সাধারণ গ্রাহক সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
বীমা খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে স্বচ্ছতা, সময়মতো দাবি নিষ্পত্তি এবং গ্রাহকসেবার মান উন্নত করা অপরিহার্য। অনেক সময় দেখা যায়, দাবির অর্থ পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় বা অপ্রয়োজনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এতে গ্রাহকের মধ্যে বীমা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়, যা পুরো খাতের ওপর প্রভাব ফেলে।
একইসঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ে আর্থিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বীমাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। এটি কোনো বিলাসিতা নয়, বরং ভবিষ্যতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার এক অপরিহার্য কৌশল। একজন সচেতন নাগরিক যেমন সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেন, তেমনি বীমা তাঁর জীবনের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত।
বীমাকে শুধুমাত্র একটি বাধ্যতামূলক চুক্তি হিসেবে নয়, বরং দায়িত্বশীল ভবিষ্যৎ চিন্তার প্রতিফলন হিসেবে দেখা উচিত। রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি— তিন স্তরেই এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কারণ বীমা কেবল ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি নয়, এটি আমাদের আর্থিক জীবনের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রতিজ্ঞা। সঠিক জ্ঞান, দায়িত্ববোধ ও দূরদর্শিতার সঙ্গে বীমা গ্রহণই পারে আগামী দিনের অনিশ্চয়তাকে রূপ দিতে এক নিশ্চিত ও নিরাপদ ভবিষ্যতে।