কম প্রিমিয়ামে মিলবে সুরক্ষা, কীভাবে সম্ভব?
রাজ কিরণ দাস: জীবন বীমা আজ কেবল একটি আর্থিক সুরক্ষা নয়, বরং এটি একটি দায়িত্বশীল জীবনযাপনের প্রতিফলন। পরিবারের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জীবন বীমা অপরিহার্য হলেও অনেকেই প্রিমিয়ামের খরচকে প্রধান বাধা মনে করেন। বাস্তবতা হলো, কিছু সচেতন পরিবর্তন ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বীমা খরচ কমিয়ে কাঙ্ক্ষিত সুরক্ষা বজায় রাখা সম্ভব। এটি যেমন অর্থ সাশ্রয়ের উপায়, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতি ও পরিবারের নিরাপত্তার এক বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল।
জীবন বীমার প্রিমিয়াম নির্ধারণে বয়স, স্বাস্থ্য, জীবনধারা ও ঝুঁকি- সবকিছুই বিবেচনায় নেওয়া হয়। যদিও বয়স কিংবা পারিবারিক চিকিৎসা ইতিহাস পরিবর্তন করা যায় না, জীবনধারার কিছু অংশ সম্পূর্ণই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ধূমপান ত্যাগ, সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও পরিমিত জীবনযাপন কেবল শারীরিক সুস্থতাই বজায় রাখে না, বরং বীমা প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধূমপায়ীদের তুলনায় অধূমপায়ীরা বীমা কোম্পানির কাছে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হন, ফলে তাদের প্রিমিয়াম স্বাভাবিকভাবেই কম হয়।
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখাও প্রিমিয়াম হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়, যা বীমা মূল্যায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ওজন কমানোর পর বা স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে বীমা কোম্পানির সঙ্গে পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রিমিয়াম কমানোর সুযোগ তৈরি হয়। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতা শুধুমাত্র জীবনধারার অংশ নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক সিদ্ধান্তও হতে পারে।
অনেকে বুঝতে পারেন না যে পেশাও বীমার খরচে প্রভাব ফেলতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ পেশা যেমন দমকলকর্মী, নির্মাণশ্রমিক বা সমুদ্রগামী কর্মক্ষেত্রে কাজ করা মানুষের জন্য প্রিমিয়াম তুলনামূলক বেশি হয়, কারণ তাদের জীবনের ঝুঁকি বেশি থাকে। অন্যদিকে তুলনামূলক নিরাপদ পেশায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য বীমা সাশ্রয়ী হয়। যদিও শুধুমাত্র প্রিমিয়াম কমানোর জন্য পেশা পরিবর্তন করা বাস্তবসম্মত নয়, তবে কেউ পেশা বদল করলে বীমা কোম্পানিকে অবহিত করলে পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ পাওয়া যায়।
ব্যক্তিগত শখও অনেক সময় বীমা প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে অদৃশ্য প্রভাব ফেলে। যেমন পাহাড়ে চড়া, স্কাইডাইভিং বা গভীর সমুদ্রে ডাইভিংয়ের মতো উচ্চঝুঁকিপূর্ণ শখ বীমা কোম্পানির কাছে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম বেড়ে যায় বা কখনও বীমা প্রদানই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই নিরাপদ শখ বা বিনোদনের বিকল্প বেছে নেয়া বীমা খরচ কমানোর পাশাপাশি ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে।
বীমা খাতে বয়স ও সময়ের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। যত আগে বীমা নেয়া যায়, তত সাশ্রয়ীভাবে কাভার পাওয়া সম্ভব। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ে, ফলে বীমা কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত লোডিং বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। তরুণ বয়সে বীমা নেয়ার সুবিধা হলো, প্রিমিয়াম তুলনামূলক কম থাকে এবং স্বাস্থ্যগত পরিবর্তন হলেও পলিসি অপরিবর্তিত থাকে।
জীবনের বিভিন্ন সময়ে বীমা পর্যালোচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বাড়ি কেনা, সন্তান জন্ম, আয় বৃদ্ধি বা বড় কোনো আর্থিক দায় গ্রহণের মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বীমা পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন তৈরি করে। সঠিক সময়ে পর্যালোচনা করলে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন যে বর্তমান পলিসি আপনার বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আছে কিনা।
তবে বীমা কেবল খরচ কমানোর হিসাব নয়; এটি একটি আর্থিক প্রতিশ্রুতি ও নৈতিক দায়বদ্ধতা। অনেক সময় সস্তা প্রিমিয়ামের প্রলোভনে অপ্রতুল কভার গ্রহণ করা ভবিষ্যতে পরিবারের আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই বীমা কেনার ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের পাশাপাশি পর্যাপ্ত কাভারেজ নিশ্চিত করাটাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
জীবন বীমার প্রিমিয়াম কমানো মানে সুরক্ষা কমিয়ে দেওয়া নয়। বরং এটি জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, আর্থিক পরিকল্পনা এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের একটি প্রক্রিয়া। ধূমপান ত্যাগ, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সময়মতো পলিসি গ্রহণ এবং নিয়মিত পর্যালোচনা- এই চারটি উপাদানই হতে পারে কার্যকর ও টেকসই সাশ্রয়ের মূল চাবিকাঠি।