বীমা খাতে ডিজিটাল রূপান্তর: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
রাজ কিরণ দাস: ডিজিটাল প্রযুক্তি আজ আর কেবল পরিপূরক নয়, বরং ব্যবসার প্রাণশক্তি। ব্যাংকিং, খুচরা ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা— সবখাতেই প্রযুক্তি নির্ভরতা দৃশ্যমান। বীমা খাতও এর বাইরে নয়। প্রথাগত সেবা কাঠামো থেকে বের হয়ে এখন এ খাতকে ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এটি একদিকে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে, অন্যদিকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জও তৈরি করছে। ফলে, এখন প্রশ্ন হলো— বীমা কোম্পানিগুলো কতটা প্রস্তুত এই রূপান্তরের সাথে তাল মেলাতে?
বীমা খাতের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ডেটা। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ তথ্য কোম্পানিগুলোর হাতে জমা হচ্ছে— প্রিমিয়াম পরিশোধের ধরণ থেকে শুরু করে দাবি নিষ্পত্তি পর্যন্ত। কিন্তু ডেটার আসল শক্তি কেবল সংগ্রহে নয়, বরং তার কার্যকর ব্যবহারে। গ্রাহকের আচরণ বোঝা, অফারকে ব্যক্তিগতকরণ করা কিংবা ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা— সবই সম্ভব ডেটা-ড্রিভেন কৌশলের মাধ্যমে। যদি প্রতিষ্ঠানগুলো ডেটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে, তবে তাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্ত হবে।
বীমা গ্রাহক এখন আর শুধু একটি পলিসি চান না; তারা চান দ্রুত, স্বচ্ছ ও তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা। এ কারণে গ্রাহক অভিজ্ঞতা উন্নয়ন এখন কোম্পানিগুলোর প্রধান লক্ষ্য। প্রসপেক্টিং থেকে শুরু করে দাবি নিষ্পত্তি কিংবা পলিসি প্রত্যাহার— প্রতিটি ধাপে গ্রাহকের প্রত্যাশা ভিন্ন। এই ভিন্নতাকে বুঝতে পারা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা পূরণ করাই হবে ডিজিটাল রূপান্তরের অন্যতম বড় সাফল্য।
আজকের গ্রাহক স্বাস্থ্যসেবা থেকে আর্থিক সেবা— সবকিছু একসাথে চান। এ কারণে বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। তারা আর শুধু বীমা পলিসি বিক্রি করলেই হবে না; বরং স্বাস্থ্যখাত, ব্যাংকিং, খুচরা বাজার কিংবা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বেঁধে ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে গ্রাহক পাবেন সমন্বিত সমাধান, আর কোম্পানিগুলোও খুঁজে পাবেন নতুন আয়ের উৎস।
ইনশিওরটেক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কারণ তারা নির্দিষ্ট সমস্যার প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান দিচ্ছে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী বীমা কোম্পানিগুলোর সামনে দাঁড়িয়েছে এক দোটানা— তারা কি প্রতিযোগিতায় নামবে, নাকি সহযোগিতায় যাবে? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সহযোগিতার পথেই বেশি সুফল মিলবে। ঐতিহ্যবাহী কোম্পানির অভিজ্ঞতা ও ইনশিওরটেকের উদ্ভাবন একত্র হলে গ্রাহককেন্দ্রিক নতুন সমাধান তৈরি করা সহজ হবে।
গ্রাহকরা আজ ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ, কল সেন্টার ও শাখা— সব মাধ্যম একসাথে ব্যবহার করছেন। তাই অমনিচ্যানেল কৌশল কেবল গ্রাহক সন্তুষ্টি বাড়ায় না, বরং কোম্পানির জন্য নতুন ডেটার ভাণ্ডারও তৈরি করে। এসব ডেটা বিশ্লেষণ করে ব্যবসার সম্পর্ক আরও ব্যক্তিগত ও কার্যকর করা সম্ভব।
ডিজিটাল রূপান্তর বিনিয়োগসাপেক্ষ। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এটি খরচ কমাতে পারে, আয় বাড়াতে পারে এবং নতুন ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। তবে ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা অপরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তাই প্রতিটি প্রযুক্তি উদ্যোগের আগে ‘রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট’ (আরওআই) স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা জরুরি।
ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো সাইবার নিরাপত্তা। গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য ও আর্থিক তথ্য সুরক্ষা দিতে না পারলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। সাইবার হামলা প্রতিরোধ, ডেটা এনক্রিপশন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন অপরিহার্য। এটি আর ব্যয় নয়; বরং ব্যবসার অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান শর্ত।
প্রযুক্তি গ্রহণ মানেই কেবল নতুন সফটওয়্যার কেনা নয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পুরো প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মী— সবাইকে ডিজিটাল মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গ্রাহককেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা ও উদ্ভাবনকে প্রতিদিনের কাজে প্রতিফলিত করতে না পারলে রূপান্তর সফল হবে না।
বীমা খাতের ডিজিটাল রূপান্তর কেবল প্রযুক্তির প্রয়োগ নয়; এটি একটি সামগ্রিক ব্যবসায়িক কৌশল, যা গ্রাহক অভিজ্ঞতা উন্নয়ন, নতুন আয়ের উৎস সৃষ্টি এবং প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। তবে চ্যালেঞ্জগুলোও ছোট নয়— সাইবার নিরাপত্তা, বিনিয়োগ ঝুঁকি, সাংগঠনিক মানসিকতার বাধা— সবই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামলাতে হবে।
ডিজিটাল রূপান্তর এখন আর ভবিষ্যতের বিষয় নয়, বরং বর্তমানের অপরিহার্য বাস্তবতা। যারা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে, তারাই আগামী দিনের বীমা বাজারে নেতৃত্ব দেবে। আর যারা পিছিয়ে পড়বে, তারা হারিয়ে যাবে প্রযুক্তির স্রোতে।