তথ্য গোপন করে হাইকোর্টে রিট, শাহ জামালের এনআরবি ইসলামিক লাইফে থাকা কতটা বৈধ

নিজস্ব প্রতিবেদক: হাইকোর্টে রিট মামলা করে এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে রয়েছেন শাহ জামাল হাওলাদার। অনুমোদিত না হয়েও নিজেকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দাবি করে এবং অপর একজনকে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি গোপন করে তিনি এই রিট মামলা করেন। সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে এই তথ্য উঠে এসেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসান্ধানে।

সূত্র মতে, আর্থিক অনিয়ম ও অপচয়ের মাধ্যমে কোম্পানি এবং গ্রাহক স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করাসহ কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরিত প্রতিবেদনে ভুল তথ্য প্রদান করে বিভ্রান্ত করার কারণে শাহ জামাল হাওলাদারের নিয়োগ নবায়নের আবেদনটি না-মঞ্জুর করে আইডিআরএ।

আইডিআরএ’র এই না-মঞ্জুরের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট মামলা করেন শাহ জামাল হাওলাদার।

নথিপত্রের তথ্য অনুসারে, শাহ জামাল হাওলাদার এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত দাবি করে রিট মামলা দায়ের করেন। অথচ বীমা আইন ২০১০ এর ৮০ ধারায় বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে অনুমোদন পেলেই কোন ব্যক্তি বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী।

আবার শাহ জামাল হাওলাদারের নিয়োগ চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন সাপেক্ষে এই চুক্তি কার্যকর হবে। ফলে আইন অনুসারে মুখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত বলে শাহ জামাল হাওলাদারের দাবি করার সুযোগ নাই।

অপরদিকে শাহ জামাল হাওলাদারের নিয়োগ নবায়ন না-মঞ্জুর করার আগে এনআরবি ইসলামিক লাইফের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় কোম্পানিটির কনসালটেন্ট মো. মিজানুর রহমানকে। তাকে নিয়োগ দেয়া হয় ৩ মাসের জন্য। তবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ দেয়া হলে মিজানুর রহমান ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহীর দায়িত্ব থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অব্যাহতি পাবেন।

এই হিসেবে শাহ জামাল হাওলাদারের নবায়ন নিয়োগ যখন না-মঞ্জর করা হয় তখন বীমা কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী ছিলেন মিজানুর রহমান।

তবে এনআরবি ইসলামিক লাইফে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে মিজানুর রহমানের নিয়োগের তথ্যটি গোপন করা হয় শাহ জামাল হাওলাদারের রিট আবেদনে। সেই সাথে এ সংক্রান্ত কোন নথিও দেয়া হয় না ওই রিট মামলার আবেদনে।

উল্লেখ্য, মিজানুর রহমানকে এনআরবি ইসলামিক লাইফের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয় ২০২৪ সালের ২৯ মে অনুষ্ঠিত কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের ১৭তম পর্ষদ সভায়।

অপরদিকে শাহ জামাল হাওলাদারের নিয়োগ নবায়নের আবেদনটি আইডিআরএ না-মঞ্জুর করে ২০২৪ সালের ১০ জুন।

আর আইডিআরএ’র এই না-মঞ্জুরের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত আদেশ দেন ২৫ জুলাই ২০২৪ তারিখে।

অর্থাৎ আদালত যেই সময়ে স্ট্যাটাস কো’র আদেশ দেন সেই সময়ে এনআরবি ইসলামিক লাইফের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন মিজানুর রহমান।

সূত্র মতে, শাহ জামাল হাওলাদার এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে প্রথম নিয়োগ পান ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর। ৩ বছরের জন্য এই নিয়োগের মেয়াদ ধরা হয় ৯ মে ২০২১ থেকে ৮ মে ২০২৪।

শাহ জামালের এই নিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গত ১৮ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে তার নিয়োগ নবায়ন অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন করেন কোম্পানিটির ভাইস চেয়ারম্যান এম মাহফুজুর রহমান।

এই নিয়োগ নবায়নের আবেদন যাচাই-বাছাই করতে ২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে আইডিআরএ। কমিটি এনআরবি ইসলামিক লাইফের আয়-ব্যয়সহ আর্থিক অবস্থা বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন দাখিল করে। এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয় ৩ জুন ২০২৪ তারিখে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বীমা আইন ২০১০ এর ১৬ ধারা লংঘন করে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ‘সুরক্ষিত দ্বিগুণ প্রদান এক কিস্তি বীমা’ বাজারজাত করেছে এনআরবি ইসলামিক লাইফ।  

এ ছাড়াও লাইফ বীমাকারীর ব্যবস্থাপনা ব্যয় সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণীয় বিধিমালা- ২০২০ অনুসারে এই বীমা পরিকল্পের ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা হবে ৫ শতাংশ এবং এই হিসাবে বিগত তিন বছরে পরিকল্পটির ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

কিন্তু বীমা কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিধিমালা লঙ্ঘন করে ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ এই ৩ বছরে মোট ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বেআইনীভাবে অতিরিক্ত খরচ করেছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি অনুমোদিত সীমা বেশি দেখিয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করে বিভ্রান্ত করেছে এবং এর মাধ্যমে কোম্পানিকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের অনুমোদিত সীমা নির্ধারণে কোম্পানি মারাত্মক অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ করেছে যার জন্য কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, তিন বছরে বীমা গ্রাহকের কাছ থেকে সংগৃহীত প্রিমিয়াম বাবদ প্রায় ৮১ কোটি ৫২ লাখ টাকার অধিকাংশ অর্থই ব্যয় করেছে এনআরবি ইসলামিক লাইফ। ফলে বীমা দাবি পরিশোধে কোম্পানিতে কোন বিনিয়োগ নেই। এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা।

এ ছাড়াও বীমা আইন ২০১০ এর ১৬ ধারা এবং লাইফ বীমাকারীর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণীয় বিধিমালা- ২০২০ অনুসারে অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ২১ কোটি ১৭ লাখ  টাকা ব্যয় করেছে এনআরবি ইসলামিক লাইফ, যা অনুমোদিত সীমার ১.৪৮ গুণ বেশি।

এনআরবি ইসলামিক লাইফে সংঘটিত এসব আর্থিক অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘনের কারণে শাহ জামাল হাওলাদারের নিয়োগ নবায়নের আবেদন না-মঞ্জুর করে আইডিআরএ। এই না-মঞ্জুর করা হয় ১০ জুন ২০২৪ তারিখে।

শাহ জামাল হাওলাদার আইডিআরএ’র না-মঞ্জুরের এই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট মামলা (নং-৯০৯৮/২০২৪) দায়ের করেন। উচ্চ আদালত আইডিআরএ’র না-মঞ্জুরের চিঠি ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে শাহ জামালকে এনআরবি ইসলামিক লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে স্থিতাবস্থা (স্ট্যাটাস কো) বজায় রাখার আদেশ করেন। ২০২৪ সালের ২৫ জুলাই আদালত এই আদেশ দেন।

বীমা আইন বিশ্লেষকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, শাহ জামাল হাওলাদারকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে বহিস্কার বা অব্যহতি দেয়া হয়নি। অব্যহতি বা বহিস্কার তখনই করা হয় যখন কোন ব্যক্তি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ও কর্মরত থাকেন।

এক্ষেত্রে শাহ জামাল হাওলাদারের নবায়ন নিয়োগের আবেদনটি না-মঞ্জুর করা হয়। অর্থাৎ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে তার নিয়োগ অনুমোদিত হয়নি। বিগত মেয়াদে দায়িত্বপালনকালে তার অনিয়মের কারণে নবায়ন নিয়োগটি না-মঞ্জুর করা হয়েছে।

অর্থাৎ শাহ জামাল হাওলাদারের নবায়ন নিয়োগের আবেদনটি যখন না-মঞ্জুর করা হয়েছে তখন তিনি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদে নিয়োগ অনুমোদনের জন্য আবেদনকারী একজন প্রার্থী। তিনি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নন।

অপরদিকে বীমা কোম্পানির জন্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের যে চুক্তি করা হয় সেখানে শর্তই দেয়া হয় আইডিআরএ’র অনুমোদন সাপেক্ষে এই নিয়োগ চুক্তি বৈধতা পাবে।

ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে অনুমোদন দেয়া না হলে বীমা কোম্পনির সাথে কোন ব্যক্তির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগের যে চুক্তি করা হয় তার কোন বৈধতা নেই।

এসব বিষয়ে শাহ জামাল হাওলাদার ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, আমরা কোথাও কোন তথ্য গোপন করিনি। কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী মিজানুর রহমানের বিষয়টি আইডিআরএ চেম্বার জজ আদালতে শুনানির সময় উপস্থাপন করেছিল। কিন্তু তখন মিজানুর রহমানের নিয়োগের মেয়াদ ৩ মাস শেষ হয়েছে এবং ৯২ দিন হয়ে যাওয়ায় আদালত সেটি গ্রহণ করেনি।

তাছাড়া কোম্পানির বোর্ড সভার রেজ্যুলেশনে মিজানুর রহমানের নিয়োগের ক্ষেত্রে আরেকটি শর্ত দিয়েছিল যে, আমার নিয়োগ অনুমোদন হলে মিজানুর রহমানের নিয়োগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অব্যাহতিপ্রাপ্ত বলে বিবেচিত হবে। আর আদালত আমার পক্ষে আদেশ দেয়ায় মুখ্য নির্বাহী পদে থাকার ক্ষেত্রে আমার আইনগত কোন বাধা নেই।

শাহ জামাল হাওলাদারের রিট মামলায় তথ্য গোপনের বিষয়ে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র পরামর্শক (মিডিয়া এবং যোগাযোগ) সাইফুন্নাহার সুমি বলেন, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন এবং শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। কর্তৃপক্ষের আইনজীবী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।