বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডে বড় অঙ্কের দাবি পরিশোধ করতে হবে বীমা কোম্পানিগুলোকে

আবদুর রহমান আবির: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট সংলগ্ন কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বীমা কোম্পানিগুলোকে বড় অঙ্কের বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এরইমধ্যে কোম্পানিগুলোর কাছে বীমা দাবি উত্থাপন শুরু করেছেন গ্রাহকরা। তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সার্ভেয়ারদের ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে না দেয়ায় এসব বীমা দাবির সার্ভে শুরু করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে বীমা কোম্পানিগুলো।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র অনুসন্ধানে ৮৩টি বীমা পলিসি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে উত্থাপিত এসব বীমা দাবির প্রায় ৭০% এয়ার অল রিস্ক পলিসি। বাকী ৩০% এয়ার রিস্ক অনলি পলিসি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বীমার আইন অনুসারে বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনায় এয়ার রিস্ক অনলি পলিসিতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও এয়ার অল রিস্ক পলিসির দাবি পরিশোধযোগ্য হবে। ফলে বীমা কোম্পানিগুলোকে মোটা অঙ্কের বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ১৮ অক্টোবর (শুক্রবার) বেলা আড়াইটায় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনায় প্রাথমিক হিসাবে আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ক্ষতি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বলে দাবি করেছে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) । বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতি জানিয়েছে, এই দুর্ঘটনার ফলে পোশাক খাতে চলমান রপ্তানি কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের অর্ডার ডেলিভারিতে বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ক্ষতি দ্রুত পুনরুদ্ধার না হলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে। তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করে বীমা দাবি পরিশোধে উদ্যোগী হতে আহবান জানিয়েছে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ) । এরইমধ্যে যেসব গ্রাহকের ক্ষতির সংবাদ এসেছে তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান এবং দ্রুত বীমা দাবি নিষ্পত্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে বীমা কোম্পানিগুলো।
প্রসঙ্গত, বীমা হলো নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে জীবন, সম্পদ বা মালামালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কোন প্রতিষ্ঠানকে স্থানান্তর করা এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে মক্কেলের আংশিক বা সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশে সাধারণত দুই ধরনের বীমা করা হয়- লাইফ বীমা ও নন-লাইফ বীমা।
বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বীমা ক্ষতির তথ্য জানার চেষ্টা করেছে ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। এ বিষয়ে নন-লাইফ বীমা এবং পুনর্বীমা কোম্পানিগুলোর স্থানীয় শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কথা হয়েছে কয়েকটি নন-লাইফ বীমা ও পুনর্বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তার সঙ্গে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) বিকেল পর্যন্ত ৪৫টি বীমা দাবি উত্থাপন হয়েছে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সে। কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেন, এসব বীমা দাবির মধ্যে ২২ জন গ্রাহকের বীমা দাবি পাওয়ার মতো। কারণ তারা এয়ার অল রিস্ক পলিসিটা নিয়েছিলেন। আর বাকি ২৩টি পলিসি নন-পে-এবল। কারণ, তারা এয়ার রিস্ক অনলি পলিসিটা নিয়েছিলেন।
আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেন, প্রিমিয়াম কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের মধ্য থেকে বেশির ভাগই তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে এয়ার রিস্ক অনলি পলিসিটা নিয়েছিলেন। ফলে তাদের বীমা দাবি পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তবে যদি বিমান বাংলাদেশের কার্গো সেকশন ফায়ার ইন্স্যুরেন্সের কাভারেজটা রাখে, তাহলে তারাও বীমা দাবি পেতে পারেন।
সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শফিক শামিম বলেন, আমাদের অন্তত ৯ জন গ্রাহকের পক্ষ থেকে মোট ৩৮টি বীমা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২টি বীমা পলিসিতে এয়ার রিস্ক অনলি কাভারেজ নেয়া। বাকী ৩৬টি পলিসিতে এয়ার অল রিস্ক কাভারেজ নেয়া হয়েছে।
এছাড়া আমাদের আরো দু’জন গ্রাহক অগ্নিকাণ্ডের পর প্রথমে বীমা দাবি উত্থাপন করলেও পরে তারা জানিয়েছেন, তাদের সব মালামাল তারা সঠিকভাবে পেয়েছেন এবং এ জন্য তাদের ক্লেইম প্রত্যাহার করেছেন। এটা খুবই ভালো কথা যে, গ্রাহকরা আমাদের বিষয়টি জানিয়েছেন।
এয়ার রিস্ক অনলি পলিসি নেয়া গ্রাহকরা তাদের ক্লেইম পাবেন কিনা জানতে চাইলে শফিক শামিম বলেন, এই ক্ষেত্রে তাদের বীমা দাবি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এয়ার রিস্ক অনলি পলিসির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিমান ক্রাশ, হাইজ্যাক ও জোড় করে অবতরনের কারণে মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়।
তিনি আরো বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার রাতেই আমরা বসে সার্ভেয়ার নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে আমাদের সার্ভেয়ররা জানিয়েছেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এ কারণে তারা এখনো সার্ভে শুরু করতে পারেনি। আমরা মনে করি, যতো তাড়াতাড়ি তাদের সেখানে ঢুকতে দেয়া হবে এবং সার্ভের কাজ শেষ হবে ততো তাড়াতাড়ি গ্রাহকদের বীমা দাবি নিষ্পত্তি করা যাবে।
ঢাকা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বায়েজীদ মুজতবা সিদ্দিকী বলেন, বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডের পর বেশি কিছু ক্লেইম এসেছিল। তবে পরবর্তীতে কিছু গ্রাহক জানিয়েছে তাদের মালামাল পাওয়া গেছে এবং সে কারণে তাদের ক্লেইম প্রত্যাহার করছে। এক্ষেত্রে ক্লেইমের প্রকৃত হিসাব এখন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কোম্পানির ক্লেইম ডিপার্টমেন্ট থেকে বিআইএ’কে একটা হিসাব দিয়েছে সেটি এসোসিয়েশনের কাছ থেকে সংগ্রহ করার পরামর্শ দেন তিনি।
পিপলস ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ক্লেইম সেকশনের কর্মকর্তা আশ্বিক জানান, এখন পর্যন্ত ১০-১২ জনের মতো গ্রাহকের কাছ থেকে ক্লেইম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ গ্রাহকই প্রিমিয়াম কম হওয়ার এয়ার রিস্ক অনলি পলিসিটা নিয়েছেলেন। এয়ার রিস্ক অনলি পলিসি নেয়া গ্রাহকরা তাদের ক্লেইম পাবেন কিনা জানতে চাইলে, তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
পুনর্বীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার শাহ আলম বলেন, এয়ার অল রিস্ক পলিসির আওতায় ওয়্যার হাউজ টু ওয়্যার হাউজ বীমা কাভারেজ থাকে। কিন্তু এয়ার রিস্ক অনলি ক্লজে কভারেজ থাকে এয়ার পোর্ট টু এয়ার পোর্ট তথা বিমানে মালামাল উঠানোর পর থেকে নামানোর আগ পর্যন্ত সময়টুকুর ঝুঁকি কাভারেজ।
এক্ষেত্রে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এয়ার রিস্ক অনলি পলিসির আওতায় থাকা মালামালের কোন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ নেই। শুধু এয়ার অল রিস্ক পলিসির আওতায় মালামালের ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। এ ছাড়াও ওয়্যার হাউজের বীমা কাভারেজ আওতায় থাকলেও কিছুটা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
জেনারেল ম্যানেজার শাহ আলম আরো বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে এ সংক্রান্ত বীমা দাবি উত্থাপন করছে গ্রাহকরা। তবে সার্ভে সম্পন্ন হওয়ার পরও বোঝা যাবে কি পরিমাণ বীমা দাবি পরিশোধযোগ্য। এ ছাড়াও আমার জানামতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি ওয়্যার হাউজের জন্য সাধারণ বীমা করপোরেশন থেকে ২০ লাখ টাকার একটি বীমা পলিসি নেয়া আছে।
বিমানবন্দর অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন (বিআইএ)’র প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ বলেন, এই দুর্ঘটনায় আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের আস্থা বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে ওঠার জন্য বীমা দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সার্ভে শেষে চূড়ান্তভাবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ হলে বীমা কোম্পানি গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করবে- এটাই নিয়ম। এক্ষেত্রে পুনর্বীমা করা থাকলে পুনর্বীমা কোম্পানি তার অংশ পরিশোধ করবে। আমরা আশা করছি- সঠিকভাবে তদন্ত হবে এবং চূড়ান্তভাবে ক্ষতি নিরূপনের পর সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানিগুলো যথাসময়ে তাদের দাবি পরিশোধ করবে।

 (1).gif)


