বীমা জালিয়াতি: আস্থার সংকটে টলমল আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

রাজ কিরণ দাস: বীমা এমন একটি আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যা জীবনের অনিশ্চয়তার মধ্যেও মানুষের মনে স্থিরতা এনে দেয়। দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসুস্থতা কিংবা সম্পদের ক্ষতি- যে কোনো বিপর্যয়ে বীমা একটি আশ্বাস দেয় যে ক্ষতির ভার একা বইতে হবে না। কিন্তু এই আস্থার ভিত্তিতেই এখন জন্ম নিচ্ছে এক গভীর সংকট- বীমা জালিয়াতি।

বীমা জালিয়াতি এমন এক অনৈতিক কর্মপ্রবণতা, যা কেবল আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, বরং বীমা খাতের বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্থিতিশীলতার ওপরও গুরুতর আঘাত হানে। এটি এমন এক প্রতারণা, যেখানে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য, অতিরঞ্জন বা ভুয়া দাবি উপস্থাপন করে অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা করে। ফলে বীমা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি- আস্থা ও সততা- ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে।

জালিয়াতির রূপ নানা রকমের হতে পারে। কখনও দুর্ঘটনা বা চুরির গল্প সাজানো হয়, কখনও ক্ষতির পরিমাণ অতিরঞ্জন করে বাড়তি ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। কেউ কেউ আবেদনপত্রে নিজের স্বাস্থ্য বা সম্পত্তি সম্পর্কিত তথ্য গোপন করে সুবিধাজনক পলিসি নিতে চান, আবার কেউ আগের ক্ষতির তথ্য লুকিয়ে রাখেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য এক- অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়া।

কেন মানুষ এমন অপরাধে জড়ায়, এর পেছনের কারণগুলোও জটিল। অনেক সময় অর্থনৈতিক চাপ, বেকারত্ব বা ঋণের বোঝা মানুষকে এই পথে ঠেলে দেয়। কেউ কেউ মনে করেন, বছরের পর বছর প্রিমিয়াম দিয়ে যে অর্থ কোম্পানির কাছে জমা দিয়েছেন, তার একটি অংশ ‘চতুরতার সঙ্গে’ ফেরত নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আবার অনেকে বীমা কোম্পানিকে ধনী ও ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান মনে করে প্রতারণাকে অপরাধ হিসেবে দেখে না। কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপরই। জালিয়াতির কারণে কোম্পানিগুলো ক্ষতি পোষাতে প্রিমিয়াম বাড়াতে বাধ্য হয়, দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া হয় জটিল ও দীর্ঘ, আর ভোগান্তি পোহাতে হয় সৎ গ্রাহকদের।

সবচেয়ে বেশি জালিয়াতি দেখা যায় মোটর, স্বাস্থ্য ও গৃহ বীমায়। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দাবি করে, কেউ নিজের গাড়ি লুকিয়ে রেখে ‘চুরি গেছে’ বলে রিপোর্ট করে, আবার কেউ চিকিৎসার খরচ বাড়িয়ে বা অস্তিত্বহীন রোগের দাবি তোলে। স্বাস্থ্য বীমায় এমনকি হাসপাতাল বা চিকিৎসকরাও অনেক সময় মিথ্যা বিল দেখায় বা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করায়। গৃহ বীমায়ও অনেকে নিজেদের সম্পত্তিতে ইচ্ছাকৃত ক্ষতি করে দুর্ঘটনা বলে দেখান। এসব প্রতারণা শুধু কোম্পানির ক্ষতি নয়, নৈতিকতারও অবক্ষয় ঘটায়।

বীমা জালিয়াতির পরিণতি বহুমাত্রিক। একদিকে কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্থিতি নড়ে যায়, অন্যদিকে গ্রাহক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে পড়ে। এর ফলে বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, বিনিয়োগ কমে যায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আস্থার সংকট এমন এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা শুধু বীমা খাত নয়, গোটা আর্থিক ব্যবস্থাকেই ঝুঁকির মুখে ফেলে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ হলো স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি। বীমা কোম্পানিগুলোর উচিত ডেটা বিশ্লেষণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সন্দেহজনক দাবিগুলো চিহ্নিত করা, পাশাপাশি গ্রাহকদেরও সচেতন করা যে বীমা কোনো ফাঁকিবাজির ক্ষেত্র নয়। সরকারেরও উচিত এই অপরাধকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতারণা রোধে উদ্যোগ নেয়া।